‘সিন্ধু-হিল্লোল’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি নজরুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘সিন্ধু হিল্লোল’ কাব্যগ্রন্থের মূলরস প্রেম। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে কাব্যগ্রন্থটির মূল সুরের সঙ্গে ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি সুর ও বক্তব্যগত বৈসাদৃশ্যই বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু জীবনের প্রতি যে গভীর অনুরাগ নজরুলের প্রেমের কবিতা রচনায় উদ্বোধিত করেছে, সেই দীপ্ত জীবনানুরাগের ফলেই দারিদ্র্যের এমন মর্ম চিত্র অঙ্কনে কবি সমর্থ হয়েছেন। বিমূর্ত দারিদ্র্যকে লাক্ষণিক বিচারে উপলব্ধি করা যায়। নজরুল বিমূর্ত দারিদ্র্যকে মূর্তি দান করেছেন জীবন্ত মানুষরূপে। কবিতার বিভিন্ন স্থানে দারিদ্র্যকে তিনি বিভিন্নরূপে সম্বোধন করেছেন—কখনো দর্পী তাপস, কখনো কাঠুরিয়া, কখনো ক্ষমাহীন ঋষি দুর্বাসা, কখনো ক্রন্দনরতা শিশুকন্যা।

দারিদ্র্য্যকে সম্বোধন করে তিনি প্রথমেই বলেছেন যে দারিদ্র্যের সংস্পর্শেই কবি সঙ্কোচহীনতা ও সাহস অর্জন করে সত্যকে প্রকাশ করতে পারছেন। দারিদ্র্যের অভিশাপেই কবির কাব্যরীণা শানিত তরবারির মতো ঝলসে উঠেছে। 

অবশ্য দারিদ্র্যের দুঃসহ ভারে কবির কাব্যসৃষ্টির অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেক কল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। কবির সৌন্দর্য ধ্যান দারিদ্র্যের তীব্র উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। দারিদ্র্য কবিকে জানিয়ে দিতে চায় যে, ‘মরবার অমৃত-সাধনা’র কাজ তাঁর নয়, তাঁকে জীবনের দুঃখের বেদনার গানই সৃষ্টি করে যেতে হবে। দারিদ্র্যরূপী বিষাক্ত নাগের জ্বালা সহ্য করে তাই কবিকে কাব্যচর্চা করে যেতে হচ্ছে।

দারিদ্র্যাকে কবি ক্ষমাহীন ঋষি দুর্বাসা বলে কল্পনা করে তাঁর তীব্র রোষের বর্ণনা দিয়েছেন। কবি কল্পনা করেছেন, দারিদ্র্যের স্পর্শেই পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর আবির্ভাব। দারিদ্র্য লক্ষ্মীর কিরীটিকে ধরায় ধূলিমগ্ন করেছে। শারদোৎসবের আগমনীতে সানাইয়ের করুণ সুর কবির কর্ণে ধ্বনিত হয়। এই সুর শুনে কবি পৃথিবীর সঙ্গে মিলনের বন্ধন অনুভব করেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটুকু আত্মস্থ করে নিতে চান। কিন্তু দারিদ্র্যের কঠোর আঘাতে তাঁর কল্পনা বিলীন হয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গ হয়। দারিদ্র্য যেন কবির শিশুকন্যারূপে ক্ষুধার জ্বালায় ক্রন্দন করতে থাকে। কিন্তু সংসারের এই সামান্য দাবীটুকু পূরণেও দারিদ্র্যপীড়িত কবি অক্ষম। তাই বিশ্বের আনন্দ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার থেকে কবি বঞ্চিত। দুঃসহ দারিদ্র্য যেন কবির স্ত্রী ও সন্তানরূপে নিয়ত ক্রন্দনরত।

‘দারিদ্র্য’ কবিতাটিতে দারিদ্র্যের দুঃসহ রূপটি কবি-কল্পনার মাধুর্যে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্যের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে ও দারিদ্র্যকে জীবন্ত চরিত্ররূপে উপস্থাপন করায় কবিতাটিতে যে বিচিত্র রসের সৃষ্টি হয়েছে— বিমূর্ত অবস্থা ও ভাবরূপে উপস্থাপন করলে সেই কাব্যরস ব্যাহত হত এবং কবিতাটি নীতিকথামূলক পদ্যে পর্যবসিত হত। কবি যদি কেবল দারিদ্র্যের ভয়ঙ্কর আত্মহননকারী বেদনাত্মক দিকটি চিত্রিত করতেন তাহলে কবিতাটি যথার্থ রসোত্তীর্ণ হতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। সম্ভবত তেমন প্রচেষ্টায় কবিতাটি বিবৃতিমূলক চিত্রমূলক চিত্রমালায় পর্যবসিত হত। দারিদ্র্যের চরম আঘাত ও দুর্দশা বাস্তব জগতে নিয়তই দৃশ্যমান কিন্তু তা কবিতায় সমর্পিত হলে রসাস্বাদনযোগ্য ভাবমণ্ডিত হওয়া প্রয়োজন। নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার উৎকর্ষ কবির একটা বিশেষ ভাবের মধ্যে অন্তরিত হয়ে আছে যা সহজেই পাঠকচিত্তে সঞ্চারিত হয়ে যায়।

কণ্টক মুকুট পরিহিত ঐতিহাসিক যীশুখ্রীস্ট এবং পৌরাণিক কালীয় নাগ, ক্রোধী ঋষি দুর্বাসা প্রভৃতি প্রসঙ্গযোগে কবি দারিদ্র্য ভাবনাকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে কাব্য-চেতনার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। কবিতাটি নজরুল সুলভ নিজস্ব বলদৃপ্ত ছন্দের ব্যবহারের পরিবর্তে তিনি এখানে চতুর্দশমাত্রিক অক্ষরবৃত্ত ছন্দই ব্যবহার করেছেন। জোরালো বিদেশী শব্দেরও অজস্র ব্যবহার এখানে নেই। কবিতাটিতে নজরুলের আবেগ গাঢ়, গভীর ও দৃঢ়সংবদ্ধ এবং প্রকাশ শাণিত, তীক্ষ্ণ ও মহিমময়। কবির আপন জীবন অভিজ্ঞতার পুটপাকে পুড়েই নজরুলের কবিসত্তা, শিল্পীসত্তা নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছিল, সেই মহত্তর অভিজ্ঞতার মহৎ সৃষ্টি এই উল্লেখ্য দারিদ্র্য’ কবিতাটি।

কবিতাটি নজরুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে স্বীকার করেও কোনো কোনো সমালোচক এই কবিতার ভাবপ্রবাহের দিক থেকে একটা বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন।

বক্তব্যের দিক থেকে কেউ কেউ কবিতাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। কবিতাটির প্রথম পংক্তি, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান।’ থেকে একাদশ স্তবকের শেষ পংক্তি ‘যত সুর আর্তনাদ হয়ে ওঠে শুনি।’— এই পর্যন্ত একই বক্তব্য। এই অংশ পর্যন্ত দারিদ্র্য কিভাবে তার জ্বালা, বিড়ম্বনার মধ্য দিয়েও মহিমান্বিত জীবন অভিজ্ঞতার ঊষর ভূমিতে কবিকে উপনীত করতে প্রয়াসী তার আলেখ্য কবি কর্তৃক উপস্থাপিত হয়েছে। কবির সুন্দরের সাধনা দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা ব্যক্ত করার সাধারণ বক্তব্যের পরেই পরবর্তী স্তবক থেকে কবির বক্তব্য একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে।

শারদ প্রভাতে পৃথিবী যখন অপরূপ সৌন্দর্যে মণ্ডিত তখনো কবির কানে ধ্বনিত হচ্ছে সানাইয়ের করুণ সুর। মাটির বুকে ম্লানমুখী শেফালিকা বিধবার হাসির মত ঝরে পড়ছে। কবির মনে পড়ে যায় দারিদ্র্যের নির্মম পেষণের কথা, সীমাহীন দারিদ্র্য যেন তাঁর পুত্র, জায়ারূপে নিত্য তাঁর সংসারে ক্রন্দনরত।

সাধারণ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবিতাটি আরম্ভ করলেও আপন ব্যক্তি জীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় যুক্ত হয়ে, কবিতাটির এই দুটি অংশ মিলেই কবিতাটি আরও সাম্র ও নিবিড় হয়ে উঠেছে। কবির বীণা যে তরবারিতে পরিণত হয়েছে তার মূলে আছে দারিদ্র্যের দুঃসহ দাহন। এই দারিদ্র্য যেমন খ্রীস্টের সম্মান দান করতে পারে তেমনি আবার তাকে মৃত্যু লাঞ্ছনায় লাঞ্ছিত করতে পারে। প্রথমদিকের এই ধ্বংসকর রূপের কঠোরতা করুণাসজল হয়ে উঠেছে কবিতাটির শেষাংশে। কবিতাটি শেষ হলেও কানের কাছে সানাইয়ের বেদনা রাগিণী বাজতে থাকে। কবিতাটির দুটি অংশ মিলে স্বাভাবিক রোমান্টিকতার সঙ্গে বাস্তববোধের হরগৌরী মিলন ঘটেছে।

ভাবপ্রবাহের দিক থেকে কোনো কোনো সমালোচক এই কবিতাটিতে একটি বৈষম্য লক্ষ্য করেছেন। তাঁদের মতে কবিতাটির সূচনায় প্রথম স্তবকে কবি দারিদ্র্যকে বহু গুণসম্পন্ন বলে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন।

“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান 

তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান

কণ্টক-মুকুট শোভা।”

কিন্তু তারপরেই দ্বিতীয় স্তবকে কবির কাছে দারিদ্র্য এক তীব্রতম যন্ত্রণাদায়ক মূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। ভাব বা চিন্তার এই বৈপরীত্যে কবিতাটির মহত্ত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে কোনো কোনো সমালোচক অভিমত প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু এই অভিমত সর্বাংশে গ্রহণ করা যায় না। কারণ কবির লক্ষ্য নানাদিক দিয়ে দারিদ্র্যের রূপ অংকন এবং তার সঙ্গে জীবনের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা। দারিদ্র্যের মহত্ত্ব এবং তার ভয়াবহ নিষ্ঠুর ও নির্মমরূপ—উভয় রূপ অংকনের মধ্য দিয়েই নিজের কথা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাছাড়া, কোনো বিষয়ের মধ্যে মহত্ত্ব থাকলে তাতে যে যন্ত্রণার তীব্রতা থাকবে না, এমন কথা বলা যায় কি? কাজেই আলোচ্য কবিতাটিতে দুটি পরস্পর বিরোধী বা অবিরোধী চিত্র অংকনের মধ্য দিয়ে কবি জীবন অভিজ্ঞতার প্রদীপকেই উজ্জ্বল করে তুলেছেন এবং ‘দারিদ্র্যা কবিতাটিতে দারিদ্র্যের রূঢ়, নির্মম, যন্ত্রণাময় বাস্তব রূপটিই ফুটে উঠেছে। ভাবের বৈপরীত্য ভাবকেই একত্ব দান করেছে।