মৃচ্ছকটিক নাটকে শূদ্রকের একটি চিরন্তন বাণী হল—’সর্বং শুন্যং দারিদ্রস্য’ – দরিদ্র মানুষের জীবনের কোনো আশাই পূর্ণ হয় না। নজরুল চিরকালই এই দারিদ্র্যের শিকার। কিন্তু দারিদ্র্য তাঁর প্রাণোচ্ছলতাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। কবিতার প্রথম স্তরে নজরুল দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়েছেন। জিশু মহাজীবনকে শুদ্ধতর করার জন্য মাথায় কাঁটার মুকুট পরে ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চির অমর হয়ে আছেন মানুষের মনে। জিশু দরিদ্র পিতামাতার সম্ভান কিন্তু তাঁর জীবন মহিমান্বিত। দারিদ্র্যে সর্বহারা কবিও জীবনের প্রতি অনুরাগে এবং তার ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ দারিদ্র্যের নিঃশব্দ অথচ ভয়াল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সেই অবস্থায় নিজেকে মহীয়ান বলে ভাবতে পেরেছেন। দারিদ্র্য যেন এক মহা তাপস! তাইতো নজরুলের অগ্নিবীক্ষায় বিষের প্রথমার্ধের বাঁশি বেজে ওঠে, তার কবিতার শব্দ নিরাভরণ তা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো লালিত কোমল নয়। তিনি উদ্ধত। দারিদ্র্যের জ্বালায় তিনি চির বিদ্রোহী। তার ভাষায় যেন বজ্রের অশনি সংকেত শ্রুত হয়, দারিদ্র্যের জ্বালায় কবির অভিশপ্ত জীবনে কাব্যের যে সমস্ত শ্রোত বয়ে চলেছে তা সর্বহারা নিঃস্ব মানুষের জয়ধ্বনিতে পূর্ণ।
দারিদ্র্য কবির নিকট ‘দর্পী তাপস’ । পৃথিবীতে তিনি কেবল অম্লান স্বর্ণালীকেই দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীর যে ঐশ্বর্যের ছটায় মানুষের মন বিমোহিত হয় কবি সেই ঐশ্বর্যের এক কণাও নিজের জীবনে পায়নি। তাই ‘বিদ্রোহী’ অথচ রণক্লান্ত কবির কাছে সব কিছুই তিন্তু ও রসহীন। যৌবনে কবি প্রেমে প্রাণে গন্ধে পুলকে যে পৃথিবীকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন জীবনের মধ্যাহ্নেই কবির সেই রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ দেখার দৃষ্টি শুকিয়ে গেল—
শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে আগ্নি বরিষণ ৷৷
এখানে দারিদ্র্য অর্থাৎ জীবনের একটা বিশেষ অবস্থাকে ব্যক্তিরূপ দান করা হয়েছে। দারিদ্র্য একজন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ও মহাতাপস। শুধু শান্ত তাপস নয়, সে দর্পী তাপস।
আগমনীর আগমনে সানাই-এর সুরে শেফালির শুভ্র সম্ভার ও তার সুগন্ধ শরৎ ঋতুকে বর্ণময় করে তোলে। বস্তু জগতের কোনো কামনাই কবির পূর্ণ হয়নি। তিনি দারিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত। বেদনার পুষ্পটির বৃত্ত কামনায় হলুদ হয়ে যায়, শেফালির মতো শুভ্র সুরভি বিহারে যখন কবির জীবন বিকশিত হতে চায় দারিদ্র্যের কাঠুরিয়ার মতো কবির স্বপ্নলোকে ছেদন করে, আশ্বিনের নব নব আনন্দ কবিকে উজ্জীবিত করে না। আশ্বিনের শিশিরে ভেজা কবিমনের তন্ত্রীতে বেজে ওঠে করুণ ধ্বনি। বেদনার সাগরে স্নাত হয়ে প্রাণের কান্না মথিত হয় কবির অন্তরভূমে—
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
করে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল ৷৷
দারিদ্র্য যেন প্রখর অর্কদেব, তার প্রজ্জ্বনান্ত তাপে করুণারূপী নিহার বিন্দু অর্থাৎ করুণাও গন্ধ হয়ে যায়। ধরণির স্নেহময় ছায়াঞ্চলে কবির জীবন ম্লান হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে কবিকণ্ঠে বিশেষ ভাণ্ড, অমৃত তো কবির মতো দুঃখী দারিদ্র্য মানুষের জন্য নয়। কবির চিত্রদীপ জ্বলে ওঠে না। দুঃখ দুর্দশাপূর্ণ জীবনে কোনো উন্মাদনাও আর নেই। দরিদ্র মানুষ দুর্বল। অমৃতের সাধনায় সে সিদ্ধ হবে কেমন করে, নাগ মন দহে বাস করে কবিও তেমনি বেদনার দহে নিমজ্জিত। বিধি যেন কবিকে কাঁটার কুঞ্জে বসিয়ে দিয়েছেন। তাই কী করে তিনি কাব্যের মালা গাঁথবেন, বিধাতা কপালে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত বেদনার যে টিকা পরিয়ে দিয়েছেন তার শাস্তি পেতে হবে কবিকে আজীবন, কবীর গান, কবির কাব্য মালিকা কবির কণ্ঠে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। কবির সর্বাঙ্গে যেন নাগিনীদের দংশন, তাই কবির গানেও বেদনার রক্ত ক্ষরণ—কবিতাতেও অতলান্ত বেদনা। তাই এ বেদনা কবির জন্মগত।
দারিদ্র্য নজরুলের কবি, শিল্পী ও ব্যক্তিগত জীবনকেই উৎপীড়ন করেনি তার পরিবেশকেও করেছে ক্ষতবিক্ষত। দারিদ্র্যের এই সর্বগ্রাসী বুভুক্ষু রূপকে কবি ক্ষমাহীন দুরাশার রূপে রূপায়িত করেছেন, ঋষি দুর্বাসা সর্বদা রুষ্ট। যেখানে নববর ও নববধূ সুখনিশি যাপনে মত্ত সেখানেই তার কঠোর ও পুরুষ কণ্ঠে ডাক শোনা যায়। নিয়ত সুখভোগী মানুষদের ঋষি দুর্বাসা রুক্ষ কণ্ঠে বলেন—“মূঢ় শোন—ধরণির বিলাস কুঞ্জ নহে নহে কারো।” নির্মম নিষ্ঠুর অদৃশ্য নিয়তি বাসর যাহাকে কাটার শজ্জায় রূপান্তরিত করে, দুর্বাসারূপী দারিদ্র্যের কণ্ঠে বজ্রগর্জনে ধ্বনিত হয় একটি কথা—’এ ধরণি বিলাসের বাগান নয়। এ নিষ্ঠুর দারিদ্র্যরূপী দুর্বাসা অনশনে ক্লীষ্ট ক্ষীণ অণু দেখে কুটিল ভূভঙ্গে দুনয়ন ভরে অগ্নিবাণ ছড়ায় তার রুদ্র রূপে পৃথিবী আতঙ্কিত। সেই দরিদ্র দুর্বাসার শাপে ধরণি মহামারী দুর্ভিক্ষ ও ঝড়ে ধ্বংস করে সমস্ত কিছু। রাজার প্রমোদ কানন পুড়ে যায়, ভগবানের নির্মম আইনে জগতে দারিদ্র্যদের মুখে শুধু যেন অমোঘ ও অনিবার্য মৃত্যুর টিকা দেখা যায়।
কল্যাণ ও ঐশ্বর্যের প্রতীক হলেন লক্ষ্মীদেবী, দারিদ্র্যের পেষণে লক্ষ্মীর মুকুট হয় ধুলায় অবলুণ্ঠিত। দেবী সরস্বতীর তন্ত্রীতে সপ্তস্বরের সুমধুর রাগিণী বাজে কিন্তু দারিদ্র্যের চূড়ান্ত আঘাতে কবি তাঁর কাব্য বীণার সুর চড়া বিদ্রোহ ও দুঃখের তারে বেঁধেছেন, সমস্ত সুর যেন আত্মার আর্তনাদে রূপান্তরিত হয়। প্রভাতকালে কবি সানাই শুনেছেন, শরতের সোনালি আলো দিনে প্রবাসী স্বামী ঘরে ফেরে, কিন্তু শরতের এই সানাইয়ে কে যেন সকরুণ ধ্বনি বাজায়। দরিদ্র ঘরের বধূদের মন সেই সুরে প্রবাসী স্বামীর দিকে ছুটে যায়। মনে হয়—
“মিলনের রাখি
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণির সাথে।”
দেবী দুর্গার আগমনে দিকে দিকে যখন প্রাণের সমারোহ তখন ধরণির সাথে মানব মনের মিলনের রাখি বাঁধা হয়। ধরণি তখন কবির কনিষ্ঠা কন্যা আদরের দুলালী হয়ে কবিকে দুটি মৃত্তিকাসিক্ত হাতে পুষ্পাঞ্জলি দিতে আসে। কিন্তু দারিদ্র্য সেই মুহূর্তে নিষ্ঠুর হয়ে গৃহের মধ্যে ক্ষুধার বেশে আবির্ভূত হয়। তাইতো কবি শরতের আগমনীর সানাই শুনেছেন কিন্তু তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে এক মর্মভুদ বেদনায়। মনে হয় তিনি সর্বরিক্ত ও সর্বহারা—
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদছে শুধু নাই, কিছু নাই।
কবিতাটির নামকরণ বিষয়কেন্দ্রিক, দারিদ্র্যের নির্মম নিষ্ঠুর আঘাতে জীবনের সব আশা আকঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। দারিদ্র্যেই জীবনের রং রূপ রস প্রাণ শুষ্ক করে দেয়। কবির কল্পলোক মরুভূমি করে তোলে। জন্ম থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়। দারিদ্র্যের জন্যেই তাঁর শিক্ষাজীবন সংক্ষিপ্ত। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসার সমুদ্রে দিয়েছিলেন ঝাঁপ। দারিদ্র্যর প্রকোপ তার জীবনকে করে দিতে চেয়েছে নিঃশ্বেষ। কিন্তু তা পারেনি, বরং দারিদ্র্যের দুঃসহ জ্বালায় তাকে মহত্তর জীবনে উন্নীত করেছিল, জীবনের গতিকে সাময়িকভাবে হারিয়ে দিতে চাইলেও দারিদ্র্যই তাকে সংগ্রামী করে তুলেছে–দারিদ্র্যই করেছে কবিকে মহান। দারিদ্র্য তার জ্বালা যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কবিকে জীবন অভিজ্ঞতার মহত্তর প্রান্তরে করেছিল উপনীত, মহাশক্তি রূপে দারিদ্র্য তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল, সেই জন্য মহাশক্তি রূপি দারিদ্র্যের বন্দনা করেছেন। সুতরাং কবিতার নাম তাই ‘দারিদ্র্য’ সঙ্গতই হয়েছে।
Leave a comment