অথবা, নগর বিপ্লব কী? নগর বিপ্লবের পটভূমি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ নগর বিপ্লব মূলত মানব সমাজের প্রগতিশীলতার একটি ধাপ। নাগরিক সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক। মানব সমাজ বিভিন্ন আবিষ্কার, উদ্ভাবন এবং পারস্পরিক প্রয়ােজনীয়তায় সংঘবদ্ধভাবে একত্রে উন্নত জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের সূত্রপাত ঘটায়।
নগর বিপ্লবের সংজ্ঞাঃ নবােপলীয় যুগের শেষ দিকে মানুষ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে এবং এই অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় সেটাই নগর বিপ্লব। নগর বিপ্লব সম্পর্কে ব্রেইন এম. ফেগান তার ‘সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “নগর বিপ্লব বর্ধিষ্ণু জনপদে সম্পন্ন হয়, যেখানে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকে; কৃষক সম্প্রদায় ক্ষুদ্র সৈন্যদল, পুরােহিত, ব্যবসায়ী, কারিগর শ্ৰেণীকে খাদ্য সরবরাহ করে লালন করে; কারিগর, শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ধাতুভিত্তিক শিল্পের বিকাশ, উন্নত যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে।”
নগর বিপ্লবের পটভূমিঃ খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দের পূর্বেই নগর বিপ্লব সংঘটিত হয়। অবশ্য সব জায়গায় একই সাথে এবং একই কারণে নগর বিপ্লব ঘটেনি। নিম্নে নগর বিপ্লবের পটভূমি আলােচনা করা হলাে –
(১) নতুন নতুন কৃষিপণ্য চাষঃ কৃষি আবিষ্কারের প্রথমদিকে মানুষ গম ও বার্লি চাষ ব্যাপকভাবে করলেও পরবর্তীতে তারা খেজুর, ডুমুর, জলপাই প্রভৃতি নতুন নতুন কৃষিপণ্য চাষ করতে শুরু করে। আর গম বা যব ক্ষেতের চেয়ে স্থায়ী ফল বাগান অনিবার্যভাবে এর মালিকদের দীর্ঘদিন একই স্থানে বসবাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ফলে এরই প্রেক্ষিতে নগর বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়।
(২) তামা আবিষ্কারঃ তামা আবিষ্কার মানব সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তামা আবিষ্কারের ফলে একে কেন্দ্র করে বহুমুখী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। লাঙ্গলে তামার ফলা ব্যবহারের কারণে চাষ কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। এতে যে সমৃদ্ধির যুগ শুরু হয় তাকে নিঃসন্দেহে বিপ্লব বলা চলে। আর এ বিপ্লব নগর বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
(৩) উন্নত আবাসন ও দালান নির্মাণঃ বৃক্ষ শাখা এবং গুহায় বসবাসরত মানুষ এক পর্যায়ে স্থায়ীভাবে কুঁড়েঘর নির্মাণ করে বসবাস আরম্ভ করে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানুষ পর্ণকুটিরে বসবাস করলেও খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দের আগেই সিরিয়া ও মেসােপটেমীয়ায় রােদে শুকানাে ইট উদ্ভাবন সভ্যতার এক নতুন সংযােজন। আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং স্থায়ী বসবাস ব্যবস্থা নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
(8) নতুন নতুন আবিষ্কারঃ খ্রিষ্টপূর্ব ৬,০০০ থেকে ৩,০০০ অব্দের মধ্যে মানুষ ষাঁড় ও বাতাসের গতিশক্তিকে কাজে লাগাতে শেখে। লাঙ্গল, চাকাওয়ালা গাড়ি, পাল তােলা নৌকা উদ্ভাবন, তামার আকরিক নিষ্কাশনের জন্য প্রযুক্তি, রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং ধাতুগুলাের ভৌত ধর্ম আবিষ্কার করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় মানব সভ্যতার এক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমেই নগর বিপ্লব সাধিত হয়।
(৫) দাস প্রথাঃ যুদ্ধ-বিগ্রহ, দরিদ্রতা ও বিরূপ পরিস্থিতি দাস প্রথা সৃষ্টি করে। দাসরা খাদ্য ও আশ্রয়ের বিনিময়ে সম্পদশালী ব্যক্তির কাজ করে দিত। এতে সম্পদশালী ব্যক্তিগণ পুঁজিপতি শ্রেণীতে পরিণত হতাে। এ পুঁজিপতি শ্রেণীর সদস্যগণ নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
(৬) সেচ ব্যবস্থা ও উন্নত উৎপাদন পদ্ধতিঃ শিকার ও সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল মানুষ ধীরে ধীরে চাষ করতে শেখে এবং জলসেচের সুবিধাজনক স্থানে বসতি গড়ে তােলে। সেচ ব্যবস্থা ও উন্নত উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করায় খাদ্য নিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এভাবে নগর বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে।
(৭) যুদ্ধ-বিগ্রহঃ সভ্যতার উন্মেষ এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষের স্বার্থ চেতনা প্রকট হয়ে উঠে। এরই প্রেক্ষিতে দলীয় কোন্দল ও গােষ্ঠীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ আরম্ভ হয়। যুদ্ধবিগ্রহে পরাজিত শত্রুদের বিজিতরা বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করে নানাবিধ সুবিধা ভােগ করতাে। এতে সামাজিক শ্রেণী সৃষ্টি হয়, যা নগর বিপ্লবের একটি শর্ত। সুতরাং দেখা যায় যুদ্ধ-বিগ্রহ নগর বিপ্লবের অনুকূলে কাজ করেছিল।
(৮) বিনিময় ব্যবস্থাঃ নব্যপ্রস্তর যুগেই কৃষকের সাথে জেলে, শিকারি, কামার, কারিগর প্রভৃতি পেশাজীবী শ্রেণীর বিনিময় ব্যবস্থা চালু হয়। বিনিময় প্রথা প্রচলনের ফলে প্রত্যক পেশাজীবী শ্রেণী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের সুযােগ পায় এবং এতে উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত হয়। ফলে পণ্য উদ্বৃত্ত থাকে এবং অবসরজীবী শ্রেণীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে নগর বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
(৯) যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতিঃ চাকা আবিষ্কারের ফলে যােগাযােগ ব্যবস্থায় গাড়ির প্রচলন নব যুগের সূচনা করে। চাকা কেবল পরিবহনেই বিপ্লব আনেনি উৎপাদনশীল শিল্প গঠনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত এবং দ্রুতগামী হওয়ায় এক অঞ্চলে আবিষ্কার ও চিন্তাধারা তাড়াতাড়ি অন্য অঞ্চলে প্রবেশ করে। এতে নগর বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
(১০) রাজা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভবঃ নগর বিপ্লবের পূর্বেই প্রভুত্ব ও দাসত্ব সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। সুবিধাভােগী শ্ৰেণী হিসেবে রাজা বা শাসক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বংশানুক্রমিক ক্ষমতার চর্চা রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটায়। এ শাসকশ্রেণী স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখতে নগর বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাতিকতায় নগর বিপ্লব এব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নতুন নতুন সৃষ্টি কর্মের উদ্দীপনা এবং প্রাকৃতিক এ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। নতুন নতুন আবিষ্কার, উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন,বিনিময় ব্যবস্থার প্রসার, যােগাযােগ ব্যবস্থার অগ্রগতি ও দিগ্বিজয়ের ফলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠে।
Leave a comment