জন স্টুয়ার্ট মিলের পূর্ববর্তী আমলের উদারনীতিবাদ হল ধ্রুপদী বা সনাতন উদারনীতিবাদ। জে. এস. মিলের পরবর্তী কালের উদারনীতিবাদকে বলা হয় আধুনিক উদারনীতিবাদ। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ হল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের উদারনীতিক ঐতিহ্য। ধ্রুপদি উদারনীতিবাদকে অনেক সময় ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিবাদ বলা হয়। কারণ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের পর্যায়ে ধ্রুপদী উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকে সনাতন উদারনীতিবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। তবে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদকে কেবল ঊনবিংশ শতাব্দীর উদারনীতিবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা অসঙ্গত। কারণ সমকালীন সনাতন উদারনীতিবাদী ধ্যান-ধারণাসমূহ অধুনা ইতিহাসের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকেই ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের নীতিসমূহ ও মতবাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের শৈশব কেটেছে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডে পুঁজিবাদী ও শিল্পবিপ্লব বিশেষভাবে সাফল্য লাভ করেছিল। সাবেকি উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ও বিস্তার বিশ্বব্যাপী বিষয় হলেও, অ্যাংলো-স্যাকসন দেশগুলিতে, বিশেষত ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই রাজনীতিক মতাদর্শের মূল অধিকতর গভীরে প্রোথিত। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, নয়া-ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ (neo-classical liberalism) বা নয়া উদারনীতিবাদও প্রাথমিকভাবে গভীর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কালক্রমে বিশ্বব্যাপী উদারনীতিবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। অবশ্য এক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সদর্থক প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও অস্বীকার করা যায় না।
ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী ধারণার মধ্যেও অল্পবিস্তর প্রকারভেদ বর্তমান। এতদসত্ত্বেও ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(ক) উদারনীতিবাদের ধ্রুপদী ধারণা অনুসারে ব্যক্তি মানুষের উপর বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতিই হল স্বাধীনতা। অর্থাৎ ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীরা স্বাধীনতার নেতিবাচক ধারণায় বিশ্বাসী। অপরের হস্তক্ষেপ বা বলপ্রয়োগ থেকে মুক্ত স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত ব্যক্তিই হল স্বাধীন।
(খ) নাগরিক সমাজ (civil society) সম্পর্কে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীরা ব্যাপকভাবে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র হল একটি বলপ্রয়োগমূলক শাসন। তুলনামূলক বিচারে নাগরিক সমাজ হল স্বাধীনতার আমল। নাগরিক সমাজের মধ্যে ভারসাম্যের নীতির প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। আত্মনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে উপরিউক্ত ধারণার অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়।
(গ) সনাতন উদারনীতিবাদে অহংবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কথা বলা হয়। এই রাজনীতিক মতাদর্শে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষ হল আত্মস্বার্থপরায়ন জীব। আত্মবিশ্বাসের সামর্থ্যও মানুষের আছে। মানব প্রকৃতির মৌলিক উপাদানসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। বহুলাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এক সমাবেশ হল এই সমাজ। স্বভাবতই সমাজকে দেখা হয় একটি পারমাণবিক প্রকৃতি বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা হিসাবে।
(ঘ) ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীরা ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় ভূমিকার পক্ষপাতী। ক্ল্যাসিক্যাল উদারনীতিকরা বিশ্বাস করেন ন্যূনতম ভূমিকাসম্পন্ন এই রাষ্ট্র কেবল প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে। এ দিক থেকে বিচার করলে রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে নেতিবাচক। জনকল্যাণ সাধনমূলক কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাষ্ট্রের থাকবে না। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ, চুক্তিসমূহ বলবৎকরণ এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে দেশের নিরাপত্তা বিধান, এই সমস্ত কাজকর্মের মধ্যেই রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকবে। টমাস পেইন (Thomus Paine)- এর অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র হল ‘অপরিহার্য বিপদ’ (necessary evil) বিশেষ।
ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের আলোচনায় বিভিন্ন রাজনীতিক মতবাদ বা তত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। সনাতন উদারনীতিবাদী রাজনীতিক মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত মতবাদসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
-
(১) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব (Theory of Natural Rights)
-
(২) উপযোগবাদ (Utilitarianism),
-
(৩) সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism),
-
(8) আর্থনীতিক উদারনীতিবাদ (Economic Liberalism)
(১) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব: স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বিশেষ কোন পথে কিছু করার বা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার স্বত্বাধিকার সাধারণভাবে অধিকার হিসাবে পরিগণিত হয়। এই স্বত্বাধিকার আইনগত বা নৈতিক প্রকৃতির হতে পারে। স্বাভাবিক অধিকার আজকাল সাধারণভাবে মানবাধিকার হিসাবে পরিচিত। মানুষের মত বেঁচে থাকার উপাযোগী পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য শর্তাদিই হল স্বাভাবিক অধিকার। জন লক ও টমাস জেফারসন (John Locke and Thomas Jefferson)-এর অভিমত অনুযায়ী কতকগুলি অধিকারকে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অধিকার বলা হয় কারণ প্রকৃতি বা ভগবানই মানব জাতিকে এই সমস্ত অধিকার দিয়েছেন। স্বাভাবিক অধিকারের উদাহরণ হিসাবে লক তিনটি অধিকারের উল্লেখ করেছেন। এই তিনটি স্বাভাবিক অধিকার হল: জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার।
লক সীমাবদ্ধ সরকারের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ। সুনির্দিষ্ট কিছু স্বাভাবিক অধিকারের সুরক্ষা সম্পাদনের মধ্যেই সরকারের ভূমিকা সীমাবদ্ধ। জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির সুরক্ষার মধ্যেই সরকারের বৈধ ভূমিকা সীমাবদ্ধ। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সম্পত্তির সুরক্ষা চুক্তিসমূহের বলবৎকরণ এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার মধ্যেই সরকারের ন্যূনতম ক্রিয়াকর্ম সীমাবদ্ধ থাকবে। অপরাপর বিষয়াদি ও দায়দায়িত্ব সঠিক বিচারে ব্যক্তিবর্গের এক্তিয়ারভুক্ত।
জেফারসনের অভিমত অনুযায়ী স্বাভাবিক অধিকার অবিচ্ছেদ্য। কারণ মানুষ হিসাবেই ব্যক্তিবর্গ এই সমস্ত অধিকারের স্বত্বাধিকারযুক্ত। এই কারণে এই সমস্ত অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা যায় না। জেফারসন কিন্তু সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার বা ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার হিসাবে স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। তাঁর মতানুসারে মানুষের সুবিধার জন্যই সম্পত্তির অধিকারের সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ ঘটেছে। মানুষের স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে জেফারসন জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের সন্ধানের কথা বলেছেন। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে জেফারসন এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তবে জেফারসনও লকের মতই সীমাবদ্ধ সরকারের কথা বলেছেন, কিন্তু অনেক পরে। তিনি বলেছেন ‘যে সরকার কম শাসন করে, সেই সরকারই শ্রেষ্ঠ (“That government is the best which government least.”)।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে ইংল্যান্ডের জন লক্ এবং আমেরিকার টমাস জেফারসন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব উদারনীতিক মতাদর্শকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। স্বাভাবিক অধিকার বা মানবাধিকারের ধারণাসমূহ বিভিন্নভাবে উদারনীতিক রাজনীতিক মতাদর্শের উপর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক।
(ক) স্বাভাবিক অধিকার ও মানবাধিকারসমূহের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই সমস্ত অধিকারের আলোচনা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারফলে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রদার্শনিক টমাস হবসের সঙ্গে গোড়ার দিককার উদারনীতিক চিন্তাবিদ জন লকের মধ্যে রাজনীতিক মতাদর্শগত অবস্থানের পার্থক্য স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়।
(খ) কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক মতাদর্শের প্রবক্তা হবস স্বাধীনতার জন্য বাসনার ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেন শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তাকে। উদারনীতিবাদী জন লক স্বৈরাচারী অবাধ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করেন। লকের অভিমত অনুযায়ী জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের সুরক্ষার স্বার্থেই সরকারের সৃষ্টি। রাষ্ট্র এই সুরক্ষার ব্যবস্থা করলে জনসাধারণ সরকার ও আইনকে মান্য করবে। নাগরিক অধিকার সরকার কর্তৃক লঙ্ঘিত হলে, জনগণের অধিকার আছে বিদ্রোহ করার।
(গ) সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-বিক্ষোভকে সমর্থন করার জন্য পরবর্তী কালে উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তির অধিকারের ধারণাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।
(২) উপযোগবাদ: উপযোগবাদ বা হিতবাদ হল ক্ল্যাসিক্যাল উদারনীতিবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। উপযোগবাদ হল একটি নৈতিক দর্শন। এই দর্শনটির উন্মেষ ও বিকাশের সঙ্গে দু’জন রাষ্ট্র দার্শনিকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham) এবং জেমস মিল (James Mill)। হিতবাদ অনুসারে ‘কল্যাণ’ বা ‘মঙ্গল’ ‘সুখ’ ‘আনন্দে’র সঙ্গে সংযুক্ত। অর্থাৎ কল্যাণ বা মঙ্গল সুখ বা আনন্দের সমার্থক। অনুরূপভাবে ‘মন্দ’ বা দুখ-কষ্ট নিরানন্দের সমার্থক। স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয় যে, সুখকে সর্বাধিক করার জন্য এবং দুঃখকে ন্যূনতম করার জন্য ব্যক্তিবর্গ কাজকর্ম করে। এ সব পরিমাপ বা বিচার করা হয় উপযোগিতা বা ব্যবহার মূল্যের মাপকাঠিতে। সাধারণত বস্তুগত ভোগের ভিত্তিতে প্রাপ্ত সন্তুষ্টির দিক থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
হিতবাদী বেন্থাম ও জেমস মিল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মানব প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ মতবাদটির অবতারণা করেন। হিতবাদ স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের একটি বিকল্প মতবাদ। বেন্থাম স্বাভাবিক অধিকার তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। হিতবাদী বেস্থামের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গ আত্মস্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সমস্ত স্বার্থ বলতে বোঝায় সুখ বা আনন্দের অভিপ্রায় এবং দুঃখ কষ্টের পরিহার। উভয়েরই পরিমাপ করা হয় উপযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে।
উপযোগিতার নীতি হল একটি নৈতিক বিষয়নীতি। এই নীতি অনুযায়ী কোন একটি নীতি, কাজ বা প্রতিষ্ঠান সঠিক কিনা নির্ধারিত হবে সুখ-আনন্দ সৃষ্টির প্রবণতার মাধ্যমে ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ’—এই নীতির ভিত্তিতে নিরূপিত হবে কোন্ নীতি সমগ্র সমাজের কল্যাণের অনুপন্থী। হিতবাদী ধ্যান-ধারণা উদারনীতিবাদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
(ক) জেরেমি বেহামের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিবর্গ তাদের পছন্দমত পথে সুখ বা আনন্দ পেতে চায়। ব্যক্তি মানুষ নিজে ছাড়া অন্য কেউ সুখ বা আনন্দের মান বা মাত্রা পরিমাপ করতে পারে না। কীসে তার সুখ, ব্যক্তি মানুষ নিজেই তা নির্ধারণ করতে পারে; অন্য কেউ পারে না। এই কারণে একমাত্র ব্যক্তিই নির্ধারণ করতে পারে নীতিগত বিচারে কোনটি সঠিক।
(খ) নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থসমূহ অনুধাবনে সক্ষম একমাত্র ব্যক্তি মানুষ নিজে। ব্যক্তিবর্গের পক্ষে অন্য কোন কর্তৃপক্ষ তা পারে না; রাষ্ট্রও তা পারে না।
(গ) উপযোগবাদীদের অভিমত অনুযায়ী মানুষ মাত্রেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই আত্মস্বার্থসর্বস্ব। মানুষজন সম্পর্কিত হিতবাদীদের এই বক্তব্য পরবর্তী প্রজন্মের উদারনীতিক চিন্তাবিরা গ্রহণ করে নিয়েছেন।
(ঘ) সর্বোপরি হিতবাদী রাষ্ট্রদার্শনিকরা ব্যক্তিবর্গের ক্রিয়াকর্মের নৈতিক দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সরবরাহ করেছেন।
আবার উদারনীতিক মতাদর্শগত বিচারে উপযোগিতাবাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছে।
- উপযোগিতাবাদী ধ্যান-ধারণার মধ্যে উদারনীতিবাদ বিরোধী বক্তব্যও বর্তমান। হিতবাদী বেস্থামের অভিমত অনুযায়ী উপযোগিতাবাদী নীতি কেবল ব্যক্তিবর্গের আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়; বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
- হিতবাদীরা ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ’ (‘the greatest good the greatest number’) নীতির উপর জোর দেন। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী এই নীতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের প্রাধান্যের বিষয়টিকে নীতিগত বিচারে সঠিক প্রতিপন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের কারণে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। উদারনীতিবাদীরা বলেন যে, মানুষমাত্রেরই ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণের সুযোগ-সুবিধা থাকা বাঞ্ছনীয়। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠেরই এই সুযোগ থাকবে, এ কথা মেনে নেওয়া যায় না। এই কারণে উদারনীতিবাদীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, হিতবাদী বেহামের ‘সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ’-এর নীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারে পরিণত হতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, উদারনীতিবাদী সমালোচনা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সমাজতন্ত্রবাদী চিন্তাবিদ্রাও উপযোগিতাবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “… this concern with the greatest number’ also explains why in the late nineteenth and early twentieth centuries socialist thinkers were also drawn to utilitarianism.”
(৩) সামাজিক ডারউইনবাদ: সামাজিক সাম্য ও দারিদ্র্য সম্পর্কে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদীরা স্বাতন্ত্র্যসূচক অবস্থান অবলম্বন করেছেন। সনাতন উদারনীতিবাদের এটি একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘অবাধ নীতি’ (laissez-faire)-র সমর্থকরা ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের ধ্যান-ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ইংরেজ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) তাঁর বিশ্ববিশ্রুত The Origin of Species শীর্ষক গ্রন্থে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তনের নীতি’ (survival of fittest) ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। এই জীববিজ্ঞানমূলক নীতির ভিত্তিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতিক বিশ্বাস ও নীতিসমূহ বিকশিত হয়। প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী ব্যক্তি মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়। ব্যক্তিবর্গ তাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুসারে নিজেদের জীবন সম্পর্কিত কাজকর্ম সম্পাদন করতে পারে। কাজ করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ উন্নতি লাভ করবে; বিপরীতক্রমে অলস ও অসমর্থ ব্যক্তিবর্গ উন্নতি লাভ করতে পারবে না, ইংরেজ দার্শনিক স্পেনসার তাঁর The Man Versus the State শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে ব্যক্তিগত আত্মনির্ভরশীলতার ধারণাকে এবং অবাধ নীতিকে বিশেষভাবে তুলে ধরেন। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের নীতি’ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা ডারউইন প্রয়োগ করেছিলেন প্রাকৃতিক দুনিয়ার ক্ষেত্রে। অনতিবিলম্বে এই নীতিটিকে সামাজিক ও রাজনীতিক মতবাদসমূহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। মানবসমাজে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ঝাড়াই বাছাই-এর প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে স্পেনসার বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। তদনুসারে সমাজ হল টিকে থাকার জন্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এক সংগ্রাম। প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে টিকে থাকার ব্যাপারে সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ উপরে উঠে যায়; অপরদিকে কমযোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ তলানিতে পড়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “Inequalities of wealth, social position and political power are therefore natural and inevitable, and no attempt should be made by government to interfere with them.”
(৪) আর্থনীতিক উদারনীতিবাদ: অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) ও ডেভিড রিকার্ডো (David Recardo) বিশিষ্ট রাজনীতিক অর্থনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ধ্রুপদী আর্থনীতিক মতবাদের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত সনাতন আর্থনীতিক মতবাদ রাজনীতিক ধ্যান-ধারণাকে প্রভাবিত করে।
নাগরিক সমাজে সরকারের অভিপ্রেত ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনায় অ্যাডাম স্মিথের অবদান উল্লেখযোগ্য। আবার মানুষের প্রকৃতি প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদের আলোচনা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃত প্রস্তাবে অ্যাডাম স্মিথের আলোচনা যুক্তিবাদী ও উদারনীতিক ধ্যান-ধারণাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এ সমস্ত বিষয়ে স্মিথের বক্তব্যের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর The Wealth of Nations শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে। স্মিথ যে সময়ে রাজনীতিক অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করেছেন, সে সময়ে আর্থনীতিক ক্রিয়াকর্মের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। অর্থাৎ আর্থনীতিক কার্যাবলীর উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণের আধিক্য কায়েম ছিল। অ্যাডাম স্মিথ এই যুক্তি খাড়া করেছেন যে, সরকারি নিয়ন্ত্রণবিহীন অর্থনীতিই সব থেকে ভাল কাজ করে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাধান্যকারী আর্থনীতিক মতবাদ ছিল বাণিজ্যতন্ত্র (mercantilism)। তদনুসারে আর্থনীতিক জীবনধারার উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার ও উৎসাহিত করা হত। অ্যাডাম স্মিথ এই বাণিজ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন। স্মিথের অভিমত অনুযায়ী অর্থনীতি হল এক বাজার বিশেষ; বা সঠিক অর্থে পরস্পর সম্পর্কিত বাজারসমূহের একটি ধারা। তাঁর মতানুসারে স্বাধীন ব্যক্তিবর্গের বিবিধ সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায় অনুযায়ী বাজার সক্রিয় হয়ে থাকে। ব্যক্তিবর্গ অনিবার্যভাবেই অহংবাদী এবং বস্তুগত স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত। স্বভাবতই আর্থনীতিক মতবাদ উপযোগিতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
অ্যাডাম স্মিথের অভিমত অনুযায়ী বাজার পরিচালিত হয় এক অদৃশ্য হাত (invisible hand) -এর দ্বারা। সুতরাং বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাজার পরিচালনার জন্য বাইরে থেকে কোন রকম নির্দেশিকা অনাবশ্যক। বাজার হল আত্মনিয়ন্ত্রিত এক ব্যবস্থা। আত্মনিয়ন্ত্রিত বাজার সম্পর্কিত ধারণার মধ্যে উদারনীতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। তদনুসারে বলা হয় যে, সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বিবদমান স্বার্থসমূহের মধ্যে স্বাভাবিক সামঞ্জস্য বা সমঝোতা বিরাজমান থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় মুক্ত বাজার আর্থনীতিক ব্যবস্থা গোঁড়ামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারফলে ‘অবাধ নীতি (laissez faire)-র বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে ইংল্যান্ডে অবাধ নীতির পরিপোষক মতবাদসমূহের আধিপত্য কায়েম থাকে। মার্কিন মুলুকে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের আগে অবধি অবাধ নীতির বিরুদ্ধে কোন রকম শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নয়া উদারনীতিবাদ (neoliberalism)-এর হাত ধরে মুক্ত বাজার নীতির পুনরুত্থান ঘটে।
Leave a comment