‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।- কবির কোন্ মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্লেষণ করো।

কবি শঙ্খ ঘোষ রচিত ‘বাবরের প্রার্থনা’ নামক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত নাম-কবিতা থেকে চয়িত পক্তিদ্বয়ে মানবের এক শাশ্বত বাণীর উন্মোচন ঘটেছে। পিতৃসত্তার আবেদন যুগ-কলি-সময়ের প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে এর অনন্তকালীন দিকটির প্রতি ইঙ্গিতদান আমাদের মতো যেকোনো পাঠককেই নতুন করে পুরোনো ক্ষতে আরাম এনে দেয়।

আমরা অনেকেই জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে ভিনদেশি ব্যবসায়ী পুরুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসরিত পিতৃসত্তা যা আমাদের বেদনার্ত করে, অভিভূত করে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর এই গল্প-প্রতিম। কবিতায় নায়ক পুরুষ হিসেবে অঙ্কণ করেছেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ বাবরকে। ইতিহাস বাবর সম্পর্কে নানারকম তথ্য দিয়ে থাকে। তাঁর যোদ্ধৃ মনোভাব তাঁর বীরত্ব আমাদের চকিত করে। শঙ্খ ঘোষ বাবরের চরিত্রের কোনো পরাক্রমী মনোবৃত্তির পরিচয়ে নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে চাননি। তিনি আলোকপাত করেছেন বাবর চরিত্রের অনালোচিত দিক। বাবর যে একজন রক্ত-মাংসে গড়া সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ। তিনি একজন স্নেহবৎসল পিতা। তিনি তার পুত্রের জন্য মনের গভীর তলদেশ থেকে যে ব্যথা অনুভব করেছেন তা অবিকল দীন-দরিদ্র যেকোনো পিতার মতোই সে ব্যথা।

বাবর, যিনি কত বড়ো ধার্মিক বা তিনি দিনে কতবার নামাজ পড়েন সে তথ্য আমাদের জানা নেই। কিন্তু এই তথ্য আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হল যে তিনি একজন বড়ো ধরনের প্রেমিক, মানব-প্রেমিক। তার সন্তানের জন্যই তার এত পরিশ্রম, রাজ্যজয়, এই ধ্রুবসত্য আমাদের ভাবিত করে। ইতিহাসের বুকে মুখ লুকানো বাবর তার পিতৃসত্তার অধিকার নিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় আমাদের চেতনায়। সন্তানের সুখের জন্য পিতার প্রাণ উৎসর্গের নজির ইতিহাসে বিরল হলেও সম্প্রতি বাবরের মধ্যে তার প্রচ্ছায়া দেখে আমাদের পূর্বতন ধারণাই পাল্টে দেয়। শঙ্খ ঘোষের এই কবিতা তাই আমাদের এক নতুন চেতনায় ঋদ্ধ করে, কবির কবিত্ব এখানেই।

‘না কি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে, কোনোই ঘ্রাণ নেই ভবিষ্যের….’
—ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ত্রাণহীণতার কারণ হিসেবে বাবরের জবানীতে কবির কোন বোধ প্রকাশিত হয়েছে? আলোচনা করো।

অসুস্থ পুত্রের আরোগ্যের জন্য সম্রাট, পিতার এক চরমতম উৎকণ্ঠার প্রকাশ ঘটেছে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায়। যে বাবর কোনোদিন নিজের রাজ্যজয় বা শত্রুসৈন্যের পরাজয়ের জন্য কখনোই মন্দিরে বা মসজিদে গিয়ে হত্তা দেননি। কিন্তু কবিতায় দেখা যাচ্ছে সেই রাজ্যজয়ী, বিজয়ী বীর বাবর তিনি মসজিদে গেছেন, সেখানে গিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। যে প্রার্থনায় রয়েছে চরম আত্মদান ও চরম Confession। তিনি নিরালঙ্কৃতভাবেই আল্লাহর কাছে তার চরম পাপের কথা স্বীকার করেছেন। রাজ্যজয়ের জন্য তিনি লাখে লাখে মানুষ খতম করেছেন, লাখ-লাখ মানুষের ঘর-বাড়ি পুঁড়িয়ে দিয়েছেন, সন্তানহারা, গৃহহারা হাজার হাজার মানুষের চোখের জলের অভিশাপ তার সন্তানের ওপর বর্তেছে।

বাবর পাপী, আর তার পাপ রক্তের ভাগিদার তার সন্তান ‘হুমায়ুন’। যার জন্য তার সেই যুবক পুত্র আজ মরণোম্মুখ। বাবর এর কারণ হিসেবে নিজেকেই দায়ী করেছেন। আমরা বাইবেল শাস্ত্রে দেখি সেখানে ত্রাণকর্তা জিশু খ্রিস্ট তাঁর শুচি রক্তের বিনিময়ে তিনি জগতের সমস্ত পাপীকে মুক্তি দিয়েছিলেন বা দিতে চেয়েছিলেন। বাবরের বক্তব্য অনুসারে আমরা দেখতে পারি তাঁর ঔরসজাত সন্তান যেহেতু পাপরক্তে পূর্ণ তাই সেই পাপীর বীজাণু তার সন্তানদেহে সঞ্চারিত হয়েছে।

আল্লাহ্র কাছে বাবর তাই তার কৃত পাপের জন্য ক্ষমার্থী। বিজ্ঞানের জ্ঞানানুসারে কারো পাপের প্রতিফল অন্যের শরীরে বর্তাতে পারে না। তবু স্নেহ-দুর্বল পিতার অন্ধবিশ্বাস হলেও আমাদের ভালোই লাগে বাবরের এই স্নেহ-দুর্বলতা। আল্লাহ্র কাছে তাই বাবর প্রশ্ন করেছেন পিতা বা জনকের কৃতকর্মের ফল থেকে আসছে প্রজন্মের কি কোনো মুক্তি নেই? বাবর এখানে সম্রাটের সোনার সিংহাসন থেকে একেবারে মাটির মানুষের কাছে এসে পড়েছেন। মানবিকতার এই চরম বিন্দুতে শঙ্খ ঘোষ আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন, যেখানে অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক তথ্যও মেনে নিতে বাধা থাকে না, ভাবী প্রজন্মের সুখের কারণে।