ধূর্জটি মহাদেবের নামান্তর। মহাদেব তাঁর তাণ্ডব-লীলার জন্য ত্রিভূবনে পরিচিত। ক্রোধোন্মত্ত মহাদেব তাণ্ডবলীলায় অর্থাৎ সংহারক মূর্তিতে যখন অবতীর্ণ হন তখন তিনি ধূম্ররূপ বা ধোঁয়ার বর্ণ ধারণ করেন, সেই জন্যই এই ধূম্ররূপী মহাদেবকে বলা হয় ধূর্জটি।

কবি এই দ্বিতীয় স্তবকে নিজের প্রচণ্ড ধ্বংসলীলার পরিচয় দিয়েছেন। এই পঙ্ক্তি দুটির অব্যবহিত পূর্বে তিনি সদর্পে জানিয়েছেন ধ্বংসের শক্তি তাঁর দুর্বার। তিনি ভরা তরী ডুবিয়ে দেন, তিনিই টর্পেডো, তিনিই জাহাজ-বিধ্বংসী মাইন। নিজের এই তাণ্ডব মূর্তির সঙ্গে তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পান মহাদেবের তাণ্ডব লীলার। তাই তিনি এই প্রসঙ্গে নিজেকে বলেছেন ধূর্জটি।

অকাল-বৈশাখী ঝড় বলতে কবি এক প্রলয়ংকর দুর্বিপাকের কথা বুঝিয়েছেন। যে অর্থে আমরা কালবৈশাখী ঝড়ের কথা বলি ঠিক সেই অর্থে অকাল-বৈশাখী নামে কোনো ঝড় নেই—এই শব্দ-ব্যবহার কবির কল্পনাপ্রসূত। কালবৈশাখী ঝড়ের সর্বনাশা মূর্তির সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। বৈশাখ মাসে এই প্রচণ্ড ঝড়ের দাপটে বাংলাদেশের বহু মানুষই থরহরি কম্পমান। কবি নিজেকে কালবৈশাখী বলেননি, বলেন অকালবৈশাখী—অর্থাৎ আরও ভয়ংকর, আরও নিদারুণ। কারণ কালবৈশাখী যতই সংহার মূর্তি ধরুক তার আবির্ভাবের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, আমরা জানি বছরের কোন সময়ে তার দাপট দেখা যাবে—সেজন্য আমরা কিছুটা সাবধান হবার সুযোগ পাই। অকালবৈশাখী বলতে কবি বুঝিয়েছেন সেই সর্বনাশা ঝড়ের দাপট, কিন্তু যার কোনো সময় অসময় নেই, যে একেবারে হঠাৎ আবির্ভূত হয়—তিলমাত্র প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে সে তার তাণ্ডব মূর্তিতে আমাদের ভীতচকিত করে তোলে। ফলে তার বিভীষিকা আরও অনেক বেশি হয়ে দেখা দেয়। কবি বলতে চান তিনি ভয়ংকর মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন এবং এই আবির্ভাব একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং পূর্বাভাসবর্জিত। তাই ভীষণতার দিক থেকে তিনি অকালে আবির্ভূত বৈশাখী ঝড়ের মতোই আকস্মিক এবং ভয়ংকর।

কবি নিজেকে বলেছেন বিশ্ব-বিধাত্রীর বিদ্রোহী সন্তান, কারণ যে সন্তান বিদ্রোহী সে নিজের পিতামাতার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণ করে বলে । যে স্রষ্টা এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অগণিত প্রাণ এবং সৌন্দর্যের উপকরণ সাজিয়েছেন—সেই স্রষ্টাই জন্ম দিয়েছেন কবিকে। কবি এই বিশ্ববিধাত্রীর সন্তান হয়েও বিশ্ববিধানের ওপর, বিশ্ব সৃষ্টির ওপর মমতাসম্পন্ন নন। তিনি ভয়াল-ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছেন সৃষ্টির বিবিধ উপকরণকে ধূলিসাৎ করে দেবার জন্য । নিজেকে তিনি ইতিপূর্বে মনে করেছেন পৃথিবীর অভিশাপ, মহাভয়। নিজেই বলেছেন—

“আমি দুর্বার,

আমি ভেঙে করি সব চুরমার!”

বিশ্বের সবকিছু ভেঙে চুরমার করার নেশায় তিনি উন্মত্ত বলেই নিজেকে আখ্যা দিয়েছেন বিদ্রোহী সন্তান, কারণ সন্তান হয়েও বিধাত্রীর অন্যান্য সৃষ্টি-সন্তানের প্রতি তিনি নির্মম।