ধাঁধা: ধাঁধাকে ইংরেজি প্রতিশব্দ বলা হয় ‘riddle’, গ্রিকভাষায় এর নাম ‘ainigma’। বাংলায় ধাঁধাকে হেঁয়ালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তৎসম প্রহেলিকা হল ধাঁধার বহুপরিচিত একটি সমনাম। ধাঁধা হচ্ছে এমন একটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন, যেখানে মূল বিষয়টি অনুক্ত থাকে এবং পাঠক বা শ্রোতা সেই লুকোনাে বিষয়কে খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়।

ধাঁধার বৈশিষ্ট্য: ধাঁধায় যে মূল বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল-

  • ধাঁধায় থাকে ভাষার প্রতি দখল, চিন্তার উৎকর্ষ এবং ছন্দ সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান।

  • ধাঁধায় প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতা দুজনেই সক্রিয় থাকে।

  • ধাঁধা যেহেতু সক্রিয়তার চর্চা, তাই এখানে বুদ্ধির অনুশীলন যেমন ঘটে, অন্যদিক দিয়ে ধাঁধা একরকমের মানসিক ক্রীড়াও বটে।

  • ধাঁধায় বুদ্ধির অনুশীলন ঘটলেও তার মধ্যে প্রবাহিত থাকে এক নির্মল হাস্যরস।

  • পরিচিত এবং দৈনন্দিন জীবন থেকে ধাঁধার উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। যেমন, শিল, নােড়া, উনুন, ছাতা, লাঠি ইত্যাদি।

  • ধাঁধায় বর্ণ, চিহ্ন, সংখ্যা, আকার, আচরণ, গুণ ইত্যাদির দিক দিয়ে সাদৃশ্য বা তুলনা আরােপ করে সংকেত তৈরি করা হয়। যেমনএকটুখানি গাছে/কেষ্ট ঠাকুর নাচে। = বেগুন = বর্ণসাদৃশ্য

সুতরাং, ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা এবং উপদেশ প্রদানের বিষয়টি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত ধাঁধাগুলিতে যেমন প্রকৃতির বিস্তার ঘটেছে, ঠিক সেভাবেই বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনও নানা ধরনের ধাঁধার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

ধাঁধাগুলিতে লক্ষ্মী নারায়ণ, অগ্নি, ব্রহ্মা, কৃষ্ণ, মনসা ইত্যাদি নানা দেবদেবীর উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও বামুন, বােষ্টম, ফকির, সন্ন্যাসী ইত্যাদি নানা ধর্ম অনুসরণকারী শ্রেণি আর ভাগবত পুরাণের উল্লেখে ধর্মাশ্রিত বাংলাদেশের ছবি নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে ধাঁধায়। চুনকাম করা ঘর কিংবা দুধভাত খাওয়া শিশুরা বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের প্রতীক হয়েই ধাঁধাতে উঠে আসে। একাধিক ধাঁধায় বিবাহসংস্কৃতির প্রতীক হয়ে এসেছে ‘সোনার টোপর’। আয়না, কাজলের ফোঁটা ইত্যাদি সাজসজ্জার দৃষ্টান্ত হয়ে ধাঁধায় আসে।

ধাঁধার উত্তরের মধ্যে বঙ্গজীবনের নিবিড় রূপটি আরও স্পষ্ট হয়। বেশ কিছু ধাঁধার উত্তরে থাকে বাংলাদেশের পরিচিত ফল, প্রাণী ইত্যাদি। অবসর বিনােদনের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হুকা এবং কলকেও কোনাে কোনাে ধাঁধায় উত্তর হিসেবে উঠে এসেছে।

লংকা, বেগুন, নারকেল, পেঁয়াজ, সজনে, ডুমুর, আনারস, পাট ইত্যাদিকে উদ্দেশ্য করেও বহু ধাঁধা রচিত হয়েছে।

আগেকার দিনে নিম্নবর্ণের মানুষরা বিশ্বাস করত ধাঁধার ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে। কখনাে কখনাে বিবাহ বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও ধাঁধার ব্যবহার চলত। সুতরাং, যে ধাঁধা এখন নিছকই শিশুমনের খােরাক, তার সামাজিক প্রেক্ষাপটকে কিন্তু কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

ধাঁধা ও প্রবাদের পার্থক্য: অনেক প্রবাদ সংগ্রাহক প্রবাদের সংগ্রহে ধাঁধাকে স্থান দিলেও এদের মধ্যে বিশেষ কিছু স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এটা ঠিক যে প্রবাদ ও ধাঁধা উভয়েই সংক্ষিপ্ত এবং উভয়েই পদ্যবন্ধ সরস রচনা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের স্বরূপ সম্পূর্ণ আলাদা।

  • প্রবাদের অর্থ বুদ্ধি দ্বারা উপলদ্ধি করতে হলেও ধাঁধার অর্থ অনেক বেশি বুদ্ধিগ্রাহ্য। কারণ ধাঁধার উদ্দিষ্ট অর্থ সম্পূর্ণ গােপনীয়।

  • প্রাত্যহিক জীবনের নানা ওঠা-পড়া এবং মেজাজের সঙ্গে প্রবাদের যােগ থাকে, কিন্তু ধাঁধা হল বুদ্ধির খেলা- যার সঙ্গে অবসর যাপনের যােগ রয়েছে।

  • প্রবাদের মধ্যে সমালােচনার প্রাধান্য থাকায় এর ভাষা অত্যন্ত তীব্র এবং প্রত্যক্ষ। অন্যদিকে, ধাঁধার ভাষা অনেকটাই কোমল এবং স্নিগ্ধ।

  • প্রবাদের ভাষায় যেখানে পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়, ধাঁধার ভাষা সেখানে কবিত্বপ্রধান।

  • প্রবাদ অপেক্ষা ধাঁধা প্রাচীন। কিন্তু সমাজজীবনের সঙ্গে যােগ থাকায় প্রবাদের যে আবেদন আজও আছে, তা ধাঁধার ক্ষেত্রে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।

  • উচ্চ মননশীলতার নিরিখে প্রবাদ আধুনিক সাহিত্যেও গ্রহণযােগ্য হয়েছে, কিন্তু ধাঁধার সেই গ্রহণযােগ্যতা এখনও তেমন তৈরি হয়নি।

প্রবাদ: প্রবাদ হল সামাজিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। আয়তনে সংক্ষিপ্ত বা অতিসংক্ষিপ্ত, যাই হােক না কেন—প্রবাদ বিষয়ের দিক থেকে এতটাই গভীর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ যে তাকে নির্দিষ্ট কোনাে সংজ্ঞায় বাঁধা অত্যন্ত কঠিন।

প্রবাদের বৈশিষ্ট্য: প্রবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • প্রবাদের আয়তন সংক্ষিপ্ত, প্রায়শই একটিমাত্র বাক্যের, কখনাে কখনাে দুটি বাক্যের হয়।

  • প্রবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রচয়িতার নামহীনতা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কবে কোন্ যুগে কোন্ প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না।

  • প্রতিটি প্রবাদই হল লােক-অভিজ্ঞতা এবং লােকদর্শনের একটি সংহত এবং সুন্দর ভাষাগত প্রকাশ।

  • স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা অতিক্রম করে সর্বজনীন এবং সর্বকালীন হয়ে ওঠার ক্ষমতা প্রতিটি প্রবাদের রয়েছে।

  • প্রবাদকে সার্থক করে তােলে এর সরল প্রকাশভঙ্গি, সহজ ভাষা এবং সাধারণ বুদ্ধির অসাধারণ প্রকাশ।

  • প্রবাদের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে ব্যঙ্গ, শ্লেষ ও বক্রোক্তির সুর। সােজাভাবে বলা কথা সাধারণত প্রবাদ হয় না।

  • আত্মসমালােচনাও কখনাে কখনাে প্রবাদের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে।

  • প্রবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তার বিষয়বৈচিত্র্য। তা যেমন দেবদেবী, পুরাণ, ইতিহাসকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে তেমনই সমাজ, পরিবার, মানুষের আচার-আচরণ, এমনকি খাদ্যবস্তু, কৃষিকর্ম ইত্যাদিকে অবলম্বন করেও রচিত হয়েছে।