সূচনা: উনবিংশ শতকে বাংলা তথা ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারায় যে সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে চলে তাতে নতুন মাত্রা যােগ করেন ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রি.)। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরের পূজারি শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের পাকে আবদ্ধ ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি। দিব্যদৃষ্টিতে লক্ষ করে সেগুলি দূর করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন।
[1] যত মত তত পথ: শ্রীরামকৃষ্ণ জাতিকে যত মত তত পথ’-এর সন্ধান দেন। তিনি তাঁর সাধনার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন যে, শৈব, বৈয়ব, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান, সাকার, নিরাকার, দ্বৈত, অদ্বৈত প্রভৃতি সব সাধনার পথ ধরেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছােনাে যায়- সাধনমার্গের সব পথই সত্য ও অভ্রান্ত।
[2] কর্মই ধর্ম: শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন যে, ঈশ্বর লাভের জন্য আচার অনুষ্ঠান, জপতপ, মন্ত্রতন্ত্র, যাগযজ্ঞ, কৃচ্ছসাধন, শুচিতা, সংসার ত্যাগ প্রভৃতির কোনাে প্রয়ােজন নেই। শুধু আন্তরিকতার দ্বারাই কোনাে মানুষ প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। ঈশ্বর সাধনার জন্য তিনি বলেছেন সংসারের আসক্তি ত্যাগ করতে, কর্মত্যাগের কথা বলেননি—নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন। তিনি ঈশ্বর সাধনার নামে কর্মে অবহেলা ও পলায়নি মনােবৃত্তিকে ঘৃণা করতেন।
[3] শিবজ্ঞানে জীবসেবা: শ্রীরামকৃষ্মের কাছে ধর্মের অর্থ হল জীবের কল্যাণ এবং জীবসেবা। জীবে দয়া নয়, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’-ই হল ধর্মের মূল আদর্শ। আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব উপাসনা নয়, শ্রীরামকৃষ্মের কাছে জীবের সেবাই পরম ধর্ম। তাঁর প্রচারের ফলে আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব হিন্দুধর্ম জটিলতামুক্ত হয়ে আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
[4] ধর্মীয় আদর্শ: শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন যে, ঈশ্বর লাভই উপাসনার মূল উদ্দেশ্য এবং চৈতন্যের পথে অগ্রসর হওয়াই মানুষের ধর্ম। সাধনামার্গের সব পথই সত্য। তার মতে, আত্মা নিষ্পাপ ও অবিনশ্বর। তাই মানুষকে পাপী বলা অন্যায়। তিনি তাঁর জীবন ও সাধনা দিয়ে প্রমাণ করেন যে, হিন্দুরা পৌত্তলিক নয়, তারা মৃন্ময়ীতে চিন্ময়ীর উপাসনা করেন।
[5] নারীমুক্তি: শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন যে, নারী হল স্বয়ং জগন্মাতার প্রতিমূর্তি। নারী জাতির দুর্দশামােচন ও নারীর নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি নারীর সুউচ্চ মহিমা ঘােষণা করেন।
[6] মানবতাবাদ: শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন যে, প্রতিটি মানুষই অনন্ত শক্তির অধিকারী। তার মানবতাবাদী আদর্শের প্রচারের ফলে সমাজে জাতপাতের বেড়াজাল ভেঙে যায়। তার গ্রাম্য আচার ব্যবহার, অর্ধনগ্ন বেশ, আভিজাত্যের প্রতি অনীহা তৎকালীন উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ।
[7] সরল আদর্শ: শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আদর্শ খুব সরল ভাষায়, বিভিন্ন গল্পের উপমা দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। সমাজের নীচুতলা বা ওপর তলার সব ধরনের মানুষই তার মুখ থেকে ধর্মের আদর্শ শােনার জন্য তার কাছে ছুটে আসতেন। স্বামী বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্র ঘােষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিনােদিনীদাসী প্রমুখ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ঠাকুরের সান্নিধ্য লাভ করেন।
মূল্যায়ন: শ্রীরামকৃষ্মের বাণী ও আদর্শ যন্ত্রণায় দগ্ধ ও কাতর মানুষের বুকে শান্তির বারিবিন্দুর মতাে ঝড়ে পড়ে। ভারতীয় সমাজের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশে তার অবদান অসামান্য। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার অন্যতম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের সুমহান আদর্শ প্রচার করেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ ঘােষ বলেছেন, “বাংলার পুনর্জাগরণে তাঁর অবদানই সর্বশ্রেষ্ঠ। তার দ্বারাই ভারতের মুক্তি ও পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে।”
Leave a comment