ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্সূচক কাব্যের নাম ‘ধর্মমঙ্গল কাব্য’। পৌরাণিক দেবতাদের মধ্যে যমকে ধর্ম নামে অভিহিত করা হলেও কাবেব্যাক্ত ধর্মের সঙ্গে নাম সাদৃশ্য ছাড়া এর অপর কোন সম্পর্ক নেই। বৌদ্ধদের ত্রি-শরণ বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙঘ— এই ধর্মের সঙ্গেও কাব্যোক্ত ধর্ম-ঠাকুরের কোন সম্পর্ক নেই। এই ধর্মঠাকুর একান্তভাবেই অনার্য দেবতা। মনসা, চণ্ডী-আদি অনার্যদেবদেবীগণ শেষ পর্যন্ত একটা আর্য-আবরণের দৌলতে অর্বাচীন। পুরাণে আশ্রয় পেলেও ধর্মঠাকুর কখনো জাতে উঠবার সুযােগ পান নি। নামটিই শুধু বৌদ্ধ ও পৌরাণিক দেবতার সমনামে উত্তীর্ণ হবার সৌভাগ্য লাভ করেছে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সুনিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছেন যে অস্ট্রীক তথা নিষাদ জাতির ‘দড়ম’ শব্দটিই আর্যসংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ‘ধর্ম শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। দড়ম’ শব্দের অর্থ ‘কুর্ম-একটি কুর্মাকৃতি প্রস্তরখণ্ডকেই ধর্মঠাকুররূপে সর্বত্র পূজা করা হয়।
অনার্য সমাজ থেকে আগত মনসা-চণ্ডী-আদি দেবদেবীগণ আর্যসমাজে গৃহীত হয়ে ব্রাহ্মণ পুরােহিতের পূজা গ্রহণেরও অধিকার অর্জন করেছেন। ধর্মঠাকুরকেও কখন কখন বিষ্ণু, শিব বা সূর্যের অবতাররূপে দেখানাের চেষ্টা করা হয়, তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘শঙ্খচক্রগদাপদ্ম চতুর্ভুজধারী’ কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি দেবসমাজে মর্যাদার আসন লাভের অধিকারী হতে পারেন নি। এখনও ধর্মঠাকুরের পূজার অধিকার রয়েছে। ডােমজাতীয় পুরােহিতের হাতে তার পূজার উপকরণে শূকর, ছাগ, সাদা মােরগ, পায়রা, মদ প্রভৃতি। অর্থাৎ ধর্মঠাকুরের আর্যীকরণ সম্পূর্ণ হয়নি বলেই তিনি এখনও অনার্য পরিমণ্ডলেই বর্তমান রয়েছেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রচার এবং ধর্মঠাকুরের পূজা রাঢ় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। কূর্মাকৃতি একখণ্ড প্রস্তরই ধর্মঠাকুর, তার জন্য মন্দিরের প্রয়ােজন নেই। যে কোন গাছের নীচে কিংবা খােলা মাঠের মধ্যেও তাঁর আসন থাকতে পারে। গ্রামদেবতা ধর্মঠাকুর স্থান ভেদে বিভিন্ন নাম গ্রহণ করে থাকেন, যথা-বাঁকুড়া রায়, যাত্রাসিদ্ধি রায়, কালু রায়, বুড়া রায়, দলু রায়, জগৎ রায় প্রভৃতি। ধর্মঠাকুরের বিবিধ পূজা—নিত্যপূজা ও মানত পূজা। মানত পূজা দীর্ঘকাল বহুজনের চেষ্টায় সম্পন্ন হয়ে থাকে—এই বিশেষ আড়ম্বরপূর্ণ পূজার নাম ‘গৃহভরণ’ বা ‘ঘর ভরা’। বার দিন বারটি শিলাকে একসঙ্গে যুক্ত করে এই পূজা করতে হয়। ধর্মপূজায় কতকগুলি পারিভাষিক নাম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নিরাকার ব্রহ্মের স্ত্রীরূপে কল্পিত শিলাখণ্ডকে বলা হয় ‘কামিন্যা’, ধর্মের সেবায়েতের নাম ‘দেয়াসী’ (দেবদাসী), দেয়াসীর প্রধান সহায়ক ধামাকনী (ধর্মাধিকারিণী?), বলির পশুর নাম ‘লুয়ে’, আর বার দিন গাইবার উপযােগী পালাগানকে বলা হয় ‘বারমতি’।
ধর্মপূজা পদ্ধতি : শূন্যপুরাণ— ধর্মমঙ্গল কাব্য ধর্ম-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। ধর্মসাহিত্যের দুটি ধারা- (১) ধর্মপূজা পদ্ধতি বা ধর্মপুরাণ এবং (২) ধর্মমঙ্গল কাব্য। এক সময় রামাই পণ্ডিত বিরচিত যে ‘শূন্যপুরাণ’কে বাঙলার প্রাচীন যুগের কাব্য বলে মনে করা হতাে, তা এই ধর্ম-পূজা পদ্ধতি বা ধর্মপুরাণ জাতীয় গ্রন্থ। এতে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদের পরিচয় পেয়েই সম্পাদক-এর ‘শূন্য-পুরাণ’ নামকরণ করেছিলেন। রামাই পণ্ডিতকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি মনে করে অনেকেই এই বিষয়ে গবেষণা করেন—কিন্তু তার জীবৎকাল অনুমিত হয়েছে নবম শতক থেকে ষােড়শ শতকের মধ্যে যে কোন সময়—অনেকেই আবার তার অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নন। শূন্যপুরাণের কোন কোন অংশ চতুর্দশ শতকের রচনাও হতে পারে, তবে অনেকটাই যে অষ্টাদশ শতকের রচনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শূন্য-পুরাণের মােট একান্নটি অধ্যায়ের মধ্যে পাঁচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে। অবশিষ্ট অধ্যায়গুলিতে বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। মহাযানপন্থী বৌদ্ধ এবং নাথপন্থীদের প্রভাব বিশেষভাবেই লক্ষ্য করা যায় শূন্যপুরাণে এবং ধর্মমঙ্গল কাব্যের সৃষ্টিতত্ত্বে। কীভাবে নিরঞ্জন ধর্ম, আদ্যাশক্তি, কাম এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু-শিবাদির উদ্ভব ঘটলাে তা এই সৃষ্টিতত্ত্বে বর্ণিত হয়েছে। দেবতা আদিত্য ধর্মের পূজা প্রচার করবার জন্য রামাই পণ্ডিতরূপে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মমঙ্গল কাব্যের হরিশ্চন্দ্রের পালা এবং সদাডােমের পালায় রামাই পণ্ডিতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী ও বিশ্লেষণ:
ধর্মমঙ্গল কাব্যে ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণিত হলেও বহুধাবিত্তৃত এবং বৈচিত্র্যময় কাহিনীই এর প্রধান আকর্ষণ। দেবী পার্বতীর প্রসাদে সােম ঘােষের পুত্র ইছাই ঘােষ গৌড়েশ্বরের সামন্তরাজ কর্ণসেনকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করলে গৌড়েশ্বর সহানুভূতিবশতঃ কর্ণসেনের সঙ্গে আপন শ্যালিকা রঞ্জাবতীর বিয়ে দিলেন। ধর্মঠাকুরের অনুগ্রহে এদের দুটি পুত্র হয়-লাউসেন ও কপূরসেন। এই লাউসেনের বিচিত্র কাহিনীই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান উপজীব্য। ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে বহু অসাধ্য সাধন করেছেন। এই প্রধান কাহিনীটি ব্যতীতও ধর্মমঙ্গল কাব্যে সদাডােম এবং হরিশ্চন্দ্র রােহিতাশ্বের (লুইধর) দুইটি উপকাহিনী যুক্ত হয়েছে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের গৌড়েশ্বর কর্ণসেন, সােম ঘােষ, ইছাই ঘােষ, লাউসেন প্রভৃতির ঐতিহাসিক অক্তিত্ব নিয়ে অনেকেই বিস্তর মাথা ঘামালেও এ বিষয়ে ডঃ সুকুমার সেনের অভিমতটিই গ্রহণযােগ্য। তিনি বলেন— “ধর্মমঙ্গল কাহিনীকে ইংরাজীতে Adventure অথবা Exploits of Lausen বলা যাইতে পারে। লাউসেনের কাহিনীগুলি প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের বাঙলার folk-tale বা উপকথা মাত্র; ইহার মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজতে গেলে ঠকব। Adventure বা কেরামতী কাহিনী বলিয়া ধর্মমঙ্গল কাব্য মনসা মঙ্গল কাব্যের অপেক্ষা অনেক অংশে সুখপাঠ্য।” তা সত্ত্বেও অনেকেই ঢেক্করীর রাজা ঈশ্বর ঘােষের সঙ্গে গ্রন্থে বর্ণিত ইছাই ঘােষকে এবং সাভারের রাজা হরিশ্চন্দ্রের সঙ্গে ধর্মমঙ্গল কাব্যের হরিশ্চন্দ্রকে একীকৃত করে দেখাতে চেষ্টা করেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের উৎস নির্দেশ করা খুব সহজ ব্যাপার । অনেকেই এর মধ্যে ইতিহাসের গন্ধ আবিষ্কার করাতেই ব্যাপারটি জটিলতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর মধ্যে যে ঐতিহাসিক কাহিনীর কোন ইঙ্গিত নেই, এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। হয়তাে বা কোন কোন লৌকিক কাহিনীর সঙ্গে ঐতিহাসিক কাহিনীর অংশবিশেষ যােজনা করে তার উপর একটা পুরাণের আবরণ চাপিয়ে বহুধাবিত্তৃত ও পল্লবিত কাহিনীটির রূপ দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে কংস-কৃষ্ণ কাহিনী এবং রামায়ণের যুদ্ধ ও মায়ামুণ্ডের কাহিনী স্পষ্টতঃই যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। লাউসেনের ভ্রাতা কপূরসেনের চরিত্রে লক্ষ্মণ ও কুশের প্রভাব এবং কালুডােমের পত্নী লখাই-চরিত্রে মহাভারতের বিদুলা- চরিত্রের প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য:
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দোষগুণ-বিষয়ে গুণিজনের মতামত বহু ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরােধী। ফলতঃ এদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান খুবই কষ্টকর। ডঃ সুকুমার সেন যেখানে ধর্মমঙ্গল কাব্যকে মনসামঙ্গল কাব্য অপেক্ষা অনেক সুখপাঠ্য বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেখানে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, “ধর্মমঙ্গলের সমস্ত যিনি পড়িয়া উঠিতে পারিবেন তাঁহার ধৈর্যের বিশেষ প্রশংসা করা উচিত হইবে।” অন্যত্র ডঃ সেন একে উপকথা এবং ‘কেরামতি কাহিনী বলে অভিহিত করেও আবার মন্তব্য করেছেন ও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য বলিয়া যদি কিছু থাকে তবে তাহা ধর্মমঙ্গল। শুধুমাত্র রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত এই ধর্মমঙ্গল কাব্যকে মঙ্গলকাব্য সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক ডঃ আশুতােষ ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় কাব্যের মর্যাদা দিতে চান। পক্ষান্তরে ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য ধর্মমঙ্গল কাব্যকে প্রাচীন বঙ্গের ‘কিশােরধর্মী সাহিত্য বলা যাইতে পারে’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। বস্তুতঃ কাহিনীতে অলৌকিকতা এবং অসমসাহসিকতার আতিশয্য একে রূপকথা জাতীয় গ্রন্থে পরিণত করেছে। মূল কাহিনীর সঙ্গে অনেক উপকাহিনী যুক্ত হওয়াতে এতে রয়েছে ঐক্যবােধের অভাব। একমাত্র ‘কানাড়া’ উপকাহিনী ব্যতীত অপর কোন উপকাহিনীতে কাব্যরস জমে উঠতে পারেনি। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচার করবার জন্য কাহিনীতে তার পাশাপাশি চণ্ডীকেও স্থাপন করার ফল কিন্তু হয়েছে বিপরীত। মানবিকতা ও সহানুভূতির গুণে চণ্ডী-চরিত্রটি অধিকতর আকর্ষণযােগ্য হয়ে ওঠায় ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের মূল উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রচুর যুদ্ধোদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এখানে বীররস জমে উঠতে পারেনি। “সর্বোাপরি, ধর্মমঙ্গলে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য দেব-দেবীর লড়াই এত উগ্র হইয়া উঠিয়াছে যে, ইহাতে মানবিকতার আবেদন তুচ্ছ হইয়া গিয়াছে।” ফলে ভক্ত ভিন্ন অপর পাঠকের নিকট ধর্মমঙ্গল কাব্য তাদৃশ আকর্ষণযােগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে রূপরাম:
ঐতিহাসিকগণ রূপরাম চক্রবর্তীকেই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতম কবি বলে মনে করেন। তিনি তার কাব্যে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তাতে জানা যায় তার পিতার নাম শ্রীরাম চক্রবর্তী, মাতা দময়ন্তী বা দৈবস্তীনিবাস ছিল বর্ধমান জেলার শ্রীরামপুর গ্রাম। কবি তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতার হাতে অনেক নির্যাতন ভােগ করেছেন। গ্রন্থেৎপত্তির কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন যে একদা এক বাঘ দেখে তিনি পুকুরপাড়ে গেলে সেখানে স্বয়ং ধর্মঠাকুর তাকে দেখা দিয়ে বলেন—
আমি ধর্মঠাকুর বাঁকুড়া রায় নাম।
বার দিনের গীত গাও শােন রূপরাম।
রূপরাম গােয়ালভূমির রাজা গণেশের আশ্রয় লাভ করে সেখানেই গীত রচনা করেন। ধর্মঠাকুরের পূজা করবার অপরাধে রূপরাম বােধ হয় সমাজচ্যুত হয়েছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, তার সমাজচ্যুতির কারণ—কোন এক হাঁড়ি জাতীয় কন্যার প্রতি আসক্তি। রূপরামের এই গ্রন্থের রচনাকালরূপে একটি শ্লোক রচনা করা হয়েছে—
শাক সীমে জড় হৈলে যত শাক হয়।
চারিবাণ তিন যুগে ভেদে যত রয়।।
রসের উপরে রস তাহে রস দেহ।
এই শােকে গীত হৈল লেখা করা লহ।
এর আবার পাঠাস্তরও আছে। যা হােক, সহজ বুদ্ধিতে এ থেকে সন তারিখ বের করা দুষ্কর হলেও উদ্যোগী পুরুষগণ এ থেকে একাধিক তারিখ উদ্ধার করেছেন, সেটি ১৫৯০ খ্রীঃ, ১৬৪৯ খ্রীঃ কিংবা ১৭২৬ খ্রীঃ অথবা অপর কোন তারিখ হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে কাব্যে শাহজাদা সুজার প্রসঙ্গ উল্লিখিত হওয়াতে মনে হয় কবি, ১৬৪৯ খ্রীঃ কাব্যটি রচনা করেছিলেন।
কবি রূপরাম কাব্যটির নাম ‘অনাদ্য-মঙ্গল’ রূপে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থের অংশমাত্র প্রকাশিত হওয়াতে সামগ্রিকভাবে গ্রন্থবিচার সম্ভবপর নয়। যতটুকু পাওয়া গেছে, তা থেকে মনে হয়, সপ্তদশ শতকের ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবিদের মধ্যে রূপরামের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে হয়। যে লাউসেনের কাহিনী ছড়া-পাঁচালি ও ব্রতকথার সীমায় আবদ্ধ ছিল, রূপরামই সম্ভবতঃ তাকে সর্বপ্রথম মঙ্গলকাব্যের জগতে উন্নীত করেন। চরিত্রসৃষ্টি, বর্ণনাভঙ্গি এবং আত্মকথা বর্ণনা প্রসঙ্গে কবির কৃতিত্বকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন- “কোন কোন সময়ে তাকে প্রায় মুকুন্দরামের মতাে প্রতিভাশালী মনে হয়, বিশেষতঃ করুণরস ও হাস্য-পরিহাসে তিনি মুকুন্দরামের সমকক্ষ। তার প্রতিভা ছিল বলে ধর্মমঙ্গল কাব্যের পরবর্তী কবিরা অনেকেই তাকে অনুসরণ করেছেন।” রূপরামের আত্মকাহিনীমূলক অংশ-বিষয়ে ডঃ সুকুমার সেনের অভিমত বিশেষ মূল্যবান— “পুরানাে বাঙ্গলা সাহিত্যে যদি আধুনিক ছােটগল্পের মত কোন জীবন-রস-নিটোাল রচনা থাকে, তবে তাহা রূপরামের এই আত্মকাহিনী।”
ধর্মমঙ্গল কাব্যে ঘনরাম:
ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যই সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্রের আনুকূল্য লাভ করাতে অবশ্যই তার প্রচার ও জনপ্রিয়তা কিছুটা সহজ পথ পেয়েছিল, কিন্তু তার জন্য তার কবিপ্রতিভাকে খাটো করে দেখা কোনক্রমেই সঙ্গত হবে না। ঘনরামের ধর্মমঙ্গল কাব্যই বঙ্গদেশে সর্বাধিক প্রচলিত ও জনপ্রিয়। কবির কাব্যে অপর কবিদের মতাে আত্মপরিচয় না থাকায় শুধুমাত্র কবিতার ওপর নির্ভর করে জানা যায় যে কবির পিতার নাম গৌরীকান্ত, মাতা সীতা এবং কবির বাসস্থান বর্ধমান জেলার কৃষ্ণপুর গ্রাম। কবি হয়তাে বর্ধমান-নরপতি কীর্তিচন্দ্রের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে থাকতে পারেন। কোন পুঁথিতে আত্মপরিচয়জ্ঞাপক যে শ্লোক পাওয়া যায়, তার প্রামাণিকতা সন্দেহাতীত নয়। তবে এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে কবি প্রভু রামচন্দ্রের অনুগ্রহেই ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন। আত্মপরিচয়জ্ঞাপক শ্লোকটি প্রামাণিক না হলেও কবি যে রামচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন এবং সম্ভবতঃ রামায়ণ গানও করতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কবির কাব্য রচনাকাল-বিষয়ে একটি পুষ্পিকা পাওয়া যায়—
শক লিখি রামগুণ রস সুধাকর।
অর্থাৎ কবি ১৬৩৩ শকাব্দে বা ১৭১১ খ্রীঃ তার কাব্যরচনা সমাপ্ত করেছিলেন। অন্যান্য ধর্ম মঙ্গল কাব্যের মতােই তিনি তাঁর কাব্যকে বারাে দিন গাইবার উপযােগী ২৪টি পালায় বিভক্ত করেন। বিষয়বস্তুতে কবির মৌলিকত্ব-প্রদর্শনের অথবা নােতুন ভাব যােজনার সুযােগ কম ছিল, তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযােগ নিয়েছেন পরিবেষণের দিক থেকে। ‘কবি-রত্ন’ উপাধিপ্রাপ্ত কবি ঘনরাম কবিত্বশক্তির সঙ্গে পাণ্ডিত্যেরও সহজ সংমিশ্রণ সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে যে তার পাণ্ডিত্য উগ্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তাও অস্বীকার করা যায় না—যেমন, ‘বিরাট-তনয় মুখ’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছেন উত্তর দিক বােঝাতে গিয়ে। তার পাণ্ডিত্যের আর একটি পরিচয় রেখেছেন তিনি বিভিন্ন সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ কিংবা সার রচনা করে। যেমন—
‘সুবৃক্ষ চন্দনগন্ধে সুশােভিত বন।
সুপুত্র হইলে গােত্রে প্রকাশে তেমন।।
কুপুত্র হইলে কুলে কুলাঙ্গার কহে।
কুবৃক্ষ কোটরে অগ্নি উঠে বন দহে।।
বিভিন্ন পুরাণ থেকে নানাবিধ উপাদান সংগ্রহ ছাড়াও কবি অনুপ্রাসাদি অলঙ্কার ব্যবহার দ্বারাও স্বীয় প্রতিভার পরিচয় রেখে গেছেন ঃ ‘চকোর-চকোরী নাচে চাহিয়া চপলা’। ঘনরাম ভাব-ভূয়িষ্ঠ পদ-রচনায় উৎকৃষ্ট ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই উত্তরকালে তাঁর রচিত বহু পদ প্রবাদবাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে। যেমন—
হাতে শঙ্ক দেখিতে দর্পণ নাই খুঁজি।
কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর রচনায় কৃতিত্ব-বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ কাব্যের বাইরের আকার প্রায় মহাকাব্যের মতাে, কিন্তু মনােভঙ্গী ও রচনাভঙ্গীতে কবি পাঁচালীর মূল আদর্শকে ছাড়াতে পারেন নি।…এর মধ্যে বীরত্ব, মনুষ্যত্ব ও নারী ধর্মের যে উচ্চ আদর্শ প্রচারিত হয়েছে তার মূল্য বিশেষভাবে স্বীকারযােগ্য। বিশেষতঃ তিনি বীরশ্রেষ্ঠ লাউসেনের অনমনীয় পৌরুষ, অদম্য বীরত্বের সঙ্গে সুপবিত্র নৈতিক আচরণকে মিলিয়ে দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়ী সাহিত্যাদর্শের মূলে একটা বলিষ্ঠ প্রাণবান্ ও শুদ্ধ জীবনকে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন এবং আংশিকভাবে সফলও হয়েছেন তার রচনাভঙ্গিমা সংস্কৃতপ্রধান ও মার্জিত, বক্তব্য বিষয়ে স্থল রুচির স্পর্শ দু’ এক জায়গায় থাকলেও গ্রাম্য ইতরতা নেই, তির্যক বাণীভঙ্গিমাও বেশ চিত্তাকর্ষী হ’য়েছে—সমাজ ও ইতিহাসের দিক থেকে এ গ্রন্থ অতিশয় মূল্যবান্। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর রামেশ্বর ও ভারতচন্দ্রের মতাে তার কাব্যও কৃত্রিমতার বাঁধন ছিড়তে পারেনি, এবং তিনি মহৎ বৃহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন নি।”
ঘনরামই ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে রসসঞ্চার ও সংস্কার সাধন করে তাকে সর্বসাধারণের গ্রহণােপযােগী করে তুলেছিলেন। তা নইলে ধর্মমঙ্গল কাব্য একান্তভাবেই একটা স্থান ও গােষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতাে। ঘনরাম যে ধর্মমঙ্গল কাব্যকে সাধারণ স্তরের উর্ধ্বে সমুন্নীত করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার সার্থক স্বীকৃতি মিলেছে বিগত যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর কবি রায়গুণাধর ভারতচন্দ্রের কাব্যে। ভারতচন্দ্র যে বহুল পরিমাণে ঘনরাম দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন তা থেকেই ঘনরামের প্রতিভার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে ময়ূরভট্ট
সহদেব চক্রবর্তীর গ্রন্থ ‘অনিলপুরাণ’ সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতকের গােড়ার দিকেই রচিত হয়েছিল। সাধারণভাবে গ্রন্থটি ‘ধর্মমঙ্গল’ নামে পরিচিত হলেও কোন কোন দিক থেকে এর স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। যেমন-ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান ঘটনা লাউসেন কাহিনী এতে বর্জিত হয়েছে। আবার ধর্মপুরাণের মত ধর্মমাহাত্ম্য, শিবায়নের মত হর-গৌরী-কাহিনী এবং গােখ-বিজয়ের মত মীননাথ গােরক্ষনাথের কাহিনী এতে বর্ণিত হয়েছে। ধর্মমঙ্গল কাব্যের হরিশ্চন্দ্র কাহিনীও এতে বিস্তৃতভাবে পরিবেষিত হয়েছে। বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশহেতু গ্রন্থটি কোন সামগ্রিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি।
Leave a comment