এখানে লেখক ধনবিজ্ঞানের একটি সূত্র প্রয়োগ করেছেন। এই সূত্রানুযায়ী বলা হয়, বিনিয়োগের হার যত উন্নত হয়, কোনো দেশের প্রগতির হারও তত উন্নত হয়। একথা বলা হয়, সোভিয়েট রাশিয়া, চিন, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশে যেখানে শিল্প উন্নত, কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনও যথেষ্ট। সেখানে এই প্রাচুর্য সম্ভব হয়েছে বিনিয়োগের হারের ওপর। বিনিয়োগ ছাড়া উৎপাদন হয় না। আর উৎপাদনের প্রাচুর্য ছাড়া দেশ উন্নত হয় না। আর্থিক প্রগতি ফলবর্তী হয় না। আর্থিক প্রগতির উন্নয়নের জন্য যে বিনিয়োগ সরকার করে, তার প্রয়োগ ও ব্যবহারের ও নির্বাচনের ওপর সাফল্য নির্ভর করে। কোন্ অর্থ কোন দিকে যাবে, কোন্ কোন্ যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে, সেই যন্ত্রপাতি দিয়ে শিল্প কীভাবে উন্নত হবে, সেই সব চিন্তাভাবনা সঠিকভাবে করলে তবেই উন্নতি যথার্থ হবে।

লেখক লিখেছেন, “বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি বলেই পূর্ব ইউরোপে, চিনে জাপানে জাতীয় উপার্জন বৃদ্ধির হার উপল গতি।” জাতীয় আয় যত ঊর্ধ্বগতি হয়, ততই দেশের আর্থিক প্রগতি সূচিত হয়। ভারতবর্ষে বিনিয়োগের হার কম বলে এখানে “প্রগতির বেগ স্তিমিত।” ভারতবর্ষে আর্থিক প্রগতি বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত হয় নি, কারণ এখানে বিনিয়োগের অঙ্ক কম। ধনবিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র “বিনিয়োগের হারের সঙ্গে আর্থিক প্রগতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক।” এই সম্পর্ক অখণ্ডিত, চিরকাল এই অখণ্ডতা বজায় থাকবে। কিন্তু এই সরল প্রাথমিক সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে কয়েকটি অনুষঙ্গের জন্ম হয়েছে। বিনিয়োগের কত অংশ ইস্পাত যন্ত্রপাতি সড়ক বন্দর-বিদ্যুৎ সেচনে ব্যয় করা হবে, কত অংশ প্রয়োজনীয় চাহিদার ইন্ধন মেটাতে ব্যয়িত হবে, তাই নির্বাচন করতে হবে। মোট যা যন্ত্রপাতি তৈরি হবে তার কত পরিমাণ জামাকাপড়-চকোলেট-ফলের গাছ-মোটরগাড়িতে ব্যয় হবে আর কতখানি নতুন যন্ত্রপাতিতে তৈরি হবে, সে ব্যাপারে একটা আদর্শ ছিল। এই আদর্শ সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রগতিকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরেছিল। “সোভিয়েট ইউনিয়নের আশ্চর্য প্রগতি আমাদের মুগ্ধতার উজ্জ্বল আকাশে উত্তীর্ণ করে। এর কারণ বিনিয়োগের ব্যবস্থা। বিনিয়োগ ছাড়া আর্থিক উন্নতি হয় না। আর এই বিনিয়োগের নির্বাচনই পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পূর্ব ইউরোপে-চিন জাপান-সোভিয়েট রাশিয়া সকলেই এই বিনিয়োগের বিস্তার দ্বারাই দেশে আর্থিক প্রগতিকে সুদৃঢ় করেছে। বিনিয়োগ সম্পর্কে সোভিয়েট মডেল হল “বিনিয়োগের হার যতদূর পারো বাড়িয়ে চলো, আপাতত আদৌ ঢিলে দিও না।” বিনিয়োগের নির্বাচন বলতে এখানে বোঝায় বিনিয়োগের পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার কোথায়। বিনিয়োগের সুফল যদি ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিনিয়োগের সুফল অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। দেশ আর্থিক বিস্তার ব্যর্থ হবে। প্রথম দিকে অশন-বসনের অভাব ঘটুক। দেশের সাধারণ মানুষ কৃচ্ছসাধন করুক। তারপরে দেশের প্রগতি অব্যাহত হয়ে উঠবে। কিন্তু বিনিয়োগের সিংহভাগ যদি ভোগ্যপণ্যে ব্যয় হয়ে যায়, তাহলে অচিরে দুঃখমগ্ন হতে পারে। ধনবিজ্ঞানের যে সূত্রের কথা এখানে বলা হয়েছে, তার অনুষঙ্গ হিসেবে এই ভাবনা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।

“সোভিয়েট পরিকল্পনায় যুক্তিসূত্রের একটা প্রত্যক্ষ সমস্যার রখুন ছিল।” কারণ নবজাগ্রত সোভিয়েটের শত্রু ছিল অনেক। এই কারণে বিনিয়োগের পরিমাণ সামরিক খাতে অনেকখানি বিশেষভাবে ব্যয় হয়েছিল। সোভিয়েটের পক্ষে এটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক প্রয়োজনকে বাদ দিয়ে একটা কথা সত্য যে বিনিয়োগের হারের ওপরই দেশের আর্থিক প্রগতি নির্ভর করে। এই পরিকল্পনাটি লেখক শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। ধনবিজ্ঞানের সূত্র অভিজ্ঞতা নির্ভর। লেখক তাই প্রথমেই বলেছেন “অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বিজ্ঞান”। সোভিয়েট দেশের মানুষ অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে বিচার করে এই সিদ্ধান্ত করেছেন। প্রাথমিক কৃচ্ছ্রসাধনার যে আবশ্যিকতার কথা সোভিয়েট পরিকল্পনায় আছে, তার থেকে সুফল লাভ করেছে সাধারণ মানুষ। এই দিক থেকে সোভিয়েট পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য।

চিনের আর্থিক প্রগতি উল্লেযোগ্যভাবে বৃদ্ধি বিনিয়াগের এই সূত্রানুযায়ী। সোভিয়েট বিনিয়োগ কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োজনানুগ হয়নি। তার ফলে “কৃষি উৎপাদনে সোভিয়েট অসাফল্যের দৃষ্টান্ত চিনেদের সাবধানতা শিখিয়েছে।” তাই তারা বুঝেছে, “শুধু বিদ্যুৎপরিবহন যন্ত্রের প্রসারের দিকেই নজর দিলে চলবে না।” কৃষিক্ষেত্রেও জোর দিতে হবে, নইলে “সোভিয়েট দেশের দশা হবে”। সোভিয়েট দেশের পরিকল্পনায় আর্থিক বিনিয়োগ কৃষিক্ষেত্রে কম হয়ছিল। তার ফলে আর্থিক উন্নতি হয়েছিল ব্যাহত। লেখক মনে করেন, “আমাদের আর্থিক অবস্থার প্রতিস্ব খুঁজতে হলে বাইরের পৃথিবীতে চিন ছাড়া অন্য কোনো দেশই নাই।” চিনেই ভারতের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ সমস্যা। চিনের সমস্যা পাঁচলক্ষ গ্রামে ছড়ানো পঁয়ত্রিশ কোটি কৃষিজীবীর মন বোঝা মন-পাওয়ার সমস্যা। “কৃষি-উৎপাদন স্রোতস্বিনী না হলে আমাদেরও মুক্তির আশা পরাহত।” “সাত লক্ষ গ্রাম নিয়ে চিনদেশে কৃষিভূমির বিস্তার এবং অন্তত চল্লিশ কোটি লোকের জীবিকা কৃষিকর্ম।”-লেখকের এই উক্তি প্রমাণ করে চিনদেশে বিনিয়োগের সমস্যা কতখানি। ধনবিজ্ঞানের প্রথম সূত্র বিনিয়োগ বৃদ্ধি না হলে আর্থিক প্রগতি সম্ভব নয়।