সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং সামন্ত ব্যবস্থার অবসান:

পরিবর্তন ও গতিশীলতা সমাজের পক্ষে স্বতঃসিদ্ধ। নতুন অবস্থার প্রভাবে সমাজের ভিতরকার শক্তি ও সম্পর্কের পরিবর্তন হয়। তার ফলে সমাজের রূপ ও গুণের পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদন শক্তির বিকাশই হল সমাজের গুণগত পরিবর্তনের মূল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশের সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের অসামঞ্জস্য ক্রমশ প্রকট হয়ে পড়ে। উৎপাদন শক্তির বিকাশের পথে সামন্ততান্ত্রিক মালিকানা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামস্ত সমাজে কৃষি ও হস্তশিল্পের শ্রমবিভাগ, নতুন নতুন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন ও ব্যবহার, কাঁচামাল থেকে নতুন ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদন প্রভৃতির ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এই সময় গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরাঞ্চলেও বাজার ও বিক্রয়প্রথার বিস্তার ঘটে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধির ফল হিসাবে শহরাঞ্চলে এক নতুন বণিক ও মহাজন শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই বণিক শ্রেণীকে ফরাসী ভাষায় ‘বারগার্স’ (Burghers) বলা হত। এই ‘বারগার্স’ শব্দটি থেকে ‘বুর্জোয়া’ (Bourgeoisic) শব্দটি এসেছে। এই বুর্জোয়া শ্রেণী বিদেশেও নতুন নতুন বাজার আবিষ্কার ও দখল করল। তার ফলে এই শ্রেণীর হাতে অপর্যাপ্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হল। তখন উন্নত ও নতুন উৎপাদন-শক্তির বিকাশ এবং নতুন সামাজিক ও আর্থনীতিক বিকাশের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হল। শিল্প-বিকাশের জন্য স্বাধীন শ্রম দরকার হয়ে পড়ল। কিন্তু কৃষকদের ব্যক্তিগত দাসত্ব একটি বাধা হয়ে দাঁড়াল। এই সময় সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান বুর্জোয়া শ্রেণী শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারের জন্য সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হল। বিকশিত শিল্প-বাণিজ্যের জন্য এক নতুন আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক কাঠামোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এই কাঠামো এমন হবে যে শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে এবং শিল্প-বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিরাপদ হবে। এই অবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থের সঙ্গে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সৃষ্টি হল। তার ফল হিসাবে নতুন উৎপাদন পদ্ধতি, নতুন শ্রেণীবিন্যাস এবং এক নতুন সমাজব্যবস্থার উদ্ভব হল। এই সমাজব্যবস্থা হল ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকা:

সামন্ত প্রথার অবসান এবং ধনতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুর্জোয়া বিপ্লবের ফলেই সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনীতিক কাঠামো অবলুপ্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবাধ রাজতন্ত্রের জায়গায় নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সামন্ত সমাজে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল সব থেকে বিপ্লবী ও প্রগতিশীল শ্রেণী। উৎপাদন-শক্তির বিকাশ এবং শিল্প-বাণিজ্যের বিস্তারের ক্ষেত্রে সামন্ত প্রথা ছিল সব থেকে বড় প্রতিবন্ধক। বুর্জোয়ারা এই সময় সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রগতিশীল আদর্শ প্রচার করে এবং সামস্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোষণ-পীড়নের শিকার ভূমিদাস, ক্ষুদ্র শিল্পী, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সহযোগিতা লাভ করে। তার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী এক অদম্য শক্তিতে পরিণত হয়। এই শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে সামত্ত শ্রেণী ও সমাজব্যবস্থার পতন ঘটে এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদ্ভব হয়।

ধনতন্ত্র ও তার প্রকৃতি:

লেনিন বলেছেন, “…বাণিজ্য ও মুদ্রা-সঞ্চালনের বিকাশ ও পৃথিবীব্যাপী বাজার গড়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মাঝে এক নূতন শ্রেণী দেখা দিল—পুঁজিপতিদের শ্রেণী…যার ফলে এক ধরনের সমাজব্যবস্থার জায়গায় এল আর এক ধরনের সমাজব্যবস্থা—সামন্ততন্ত্রের জায়গায় এল পুঁজিবাদ।” পুরাতন সমাজব্যবস্থার ভিতর থেকেই নূতন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই কৃষিকার্য ও ক্ষুদ্রায়তন হস্তশিল্পে উৎপাদন শক্তির অতি দ্রুত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই নূতন যন্ত্রপাতির প্রয়োগ উৎপাদন ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। মালিক শ্রেণী যখন থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্বৃত্ত সামগ্রী ও অধিক মুনাফা অর্জনে প্রবৃত্ত হয় তখন থেকেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পদধ্বনি শোনা যায়। তবে শিল্প-বিপ্লবের পরই পুঁজিবাদের সাড়ম্বর আবির্ভাব ঘটে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে তখন যন্ত্রপাতির বহুল ব্যবহার, নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারা প্রযুক্তিবিদ্যা ও উৎপাদন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ, উন্নত মূলধনের ভিত্তিতে শ্রমিকের উৎপাদন শক্তির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উন্নত যন্ত্রপাতি, উৎকৃষ্ট উৎপন্ন দ্রব্য প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানগুলির মালিকানা পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। জমি, কল-কারখানা প্রভৃতির অধিকারী হল এই পুঁজিপতিরা। আপাতদৃষ্টিতে সর্বহারা শ্রমিকরা মুক্ত ও স্বাধীন বলে মনে হয়। কিন্তু কার্যত তারা মালিক শ্রেণীর আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণের অধীন। এই শ্রমিক সম্প্রদায় উৎপাদনের সর্বপ্রকার উপকরণ থেকে বঞ্চিত। তারা সহায়-সম্বলহীন। নিজেদের শ্রমশক্তিটুকুই তাদের একমাত্র পুঁজি। সেইজন্য এই দরিদ্র ও দুর্বল শ্রমিক শ্রেণীকে জীবনধারণের জন্য অনন্যোপায় হয়ে পুঁজিপতিদের কাছে তাদের শ্রম বিক্রয় করতে হয়। শ্রমিকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগে মালিকগণ নামমাত্র মজুরী দিয়ে তাদের শোষণ করে। অধ্যাপিকা ড. দাশগুপ্ত মন্তব্য করেছেন: “….. পুঁজিবাদী উৎপাদনের অর্থ শুধু দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন নয়। সেটি হল অতিরিক্ত মূল্যের উৎপাদন নিঃসন্দেহে। শ্রমিক তো নিজের জন্য উৎপাদন করে না, করে পুঁজির জন্য আর এই উৎপাদন ‘অতিরিক্ত’ হওয়া চাই। ফলে, পুঁজিবাদী সমাজের সমীকরণ হতে পারে ‘শ্রেণী বিভক্ত’ সমাজে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের পরিণতি মালিক শ্রমিক-এর আপসে নয়, সংঘর্ষে, শ্রেণীসংগ্রামে; যতদিন পর্যন্ত না শোষণের যন্ত্রটি অপসারিত হচ্ছে এবং সমাজের উত্তরণ ঘটছে ‘সামন্ততান্ত্রিক স্তর’-এ।”

উদ্বৃত্ত মূল্য ও শ্রমিকশোষণ:

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণের একটি বিশেষ ধরন আছে। শ্রমিকদের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি শ্রেণী মুনাফা বৃদ্ধি ও শ্রমিক শোষণ অব্যাহত রাখে। উদ্বৃত্ত মূল্য হল উৎপন্ন সামগ্রীর সেই অংশের মূল্য যা উৎপাদনের জন্য শ্রমিককে কোন মজুরী দেওয়া হয় না। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের মজুরী তার উৎপাদিত সামগ্রীর মূল্য অপেক্ষা সবসময়েই কম হয়। শ্রমিক তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে যে পরিমাণ বঞ্চিত হয় তাই উদ্বৃত্ত মূল্য। মালিকশ্রেণী শ্রমিক-শোষণের মাধ্যমে তা কুক্ষিগত করে এবং তাদের মুনাফা ও মূলধনের সঞ্চয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ধনতন্ত্রে পুঁজিপতিদের শ্রমিক-শোষণ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের অপহরণকে অব্যাহত রাখার জন্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এই পর্বে শোষক পুঁজিপতিদের স্বার্থে, শোষিত শ্রমিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়। ধনতন্ত্রের দ্রুত ও ব্যাপক বিস্তারের স্বার্থে অর্থব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এই সময় বলা হয় যে রাষ্ট্র কেবল পুলিসী কার্য সম্পাদন করবে, অর্থাৎ কেবল শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। আর আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। একেই বলে স্বাচ্ছন্দ্য নীতি (Laissez faire)। তবে পরে এই নীতির পরিবর্তন ঘটেছে।

আধুনিক প্রবণতা:

বর্তমান কালে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি উৎপাদন ও বাণিজ্য-ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পুঁজিবাদের মৌলিক সংকট এবং ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি অপসারণের চেষ্টা করছে। ব্যক্তিগত একচেটিয়া কারবারের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া কারবার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া ধনতন্ত্র (State Monopoly Capitalism) হিসাবে পরিচিত। আবার কোন কোন দেশে সমাজতন্ত্রের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করে এক মিশ্র অর্থনীতি (Mixed Economy) গড়ে উঠেছে।

ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।

  • (১) ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের কলাকৌশল, প্রযুক্তিবিদ্যা, শিল্প-সংগঠন প্রভৃতির উন্নতি সাধিত হয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট যন্ত্রপাতির বহুল ব্যবহার এবং উন্নত মূলধনের ভিত্তিতে শ্রমিকের উৎপাদন-শক্তির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়।

  • (২) ধনতন্ত্রে উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানা পুঁজিপতির হাতে থাকে। উৎপাদনের সকল প্রকার উপাদান হতে শ্রমিক শ্রেণী বঞ্চিত।

  • (৩) আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিক সম্প্রদায় মুক্ত ও স্বাধীন হলেও, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় জীবনধারণের জন্য তারা পুঁজিপতিদের কাছে শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়।

  • (৪) মালিকশ্রেণী শ্রমিকদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে ন্যায্য পাওনা থেকে তাদের বঞ্চিত করে এবং উদ্বৃত্ত মূল্য ভোগ ও শ্রমিক-শোষণ কায়েম করে।

  • (৫) ধনতন্ত্রে পুঁজিপতিরা শোষকের ভূমিকায় থাকে এবং শ্রমিক-শ্রেণী শোষিত হতে থাকে। 

  • (৬) সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর উপর পুঁজিপতিদের শোষণকে অব্যাহত রাখার জন্যই রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

  • (৭) এই পর্যায়ে নারীরা আর্থনীতিক দিক থেকে পরাধীন। তাই তাদের উপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।