দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার – সম্পর্কিত একটি ভাষণ রচনা কর।
আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, আলোচকবৃন্দ ও উপস্থিত সুধী— আপনাদের প্রতি রইল আমার সালাম ও শ্রদ্ধা ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আজ জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম । তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি জনজীবনের ওপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্দশা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। অথচ কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না ।
সম্মানিত সুধী
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির স্বেচ্ছাচারিতাই প্রমাণ করে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো কতটা দুর্বল, আমরা কেন বারবার দুর্নীতিতে শিরোপা অর্জন করছি । দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ তার আয়ের সাথে ব্যয়ের মোটেই সামঞ্জস্য রাখতে পারে না । তাই দেখা যায়, কোথাও কোথাও ব্যক্তিবাজেট কিংবা রাষ্ট্রীয় বাজেট ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অর্থসংকট সহ নানাবিধ বাধা-বিপত্তি আসে । তাই অনেক মূল্যবান পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখার আগেই গুটিয়ে নিতে হয় ।
প্রিয় সুধী
আজকের বাজার করে আগামীকালের বাজারের ব্যয় সম্বন্ধে যেমন ধারণা দেওয়া যায় না তেমনি আমাদের আর্থনীতিক ব্যবস্থা যে কোথায় পৌঁছাবে বলা যায় না। ফলে এক অসামঞ্জস্যতায় আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সঙ্গতি না থাকায় ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় সীমাহীন আক্রোশ । এর ফলে সমাজের অভ্যন্তরে জন্ম নেয় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড । ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্মে । মধ্যবিত্তের প্রায় অনুরূপ দশা । অবশ্য উচ্চবিত্তদের কথা আলাদা বরং তারা দ্রবমূল্যের বৃদ্ধির সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায় ।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ
হু হু করেই যেন চাল, ডাল, মাছ, মাংস ও সবজির দাম বাড়ে; এগুলো একবার বেড়ে গেলে আর কোনোক্রমেই কমে না। আর এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায় অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য । এমনও দেখা যায়, কিছু জিনিসপত্রাদির মূল্য বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণই নেই, তথাপি মূল্য বৃদ্ধি পায় ।
প্রিয় সুধী
মূল্য বৃদ্ধির কোনো উপযুক্ত কারণ আজও আমাদের দেশে উদ্ঘাটিত হয়নি । তাই তো সারাবছর যে ছোলা, ডাল, তেল, তরিতরকারির বাজার মূল্য স্বাভাবিক থাকে, হঠাৎ করে রমজান মাসে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়; অথচ রমজান সংযমের মাস তথা কৃচ্ছ্র-সাধনের মাস ।
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
আর্থনীতিক দৃষ্টিতে বলা হয় চাহিদার তুলনায় জোগানের অপ্রতুলতা ঘটলেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মৌসুমে গ্রামে যখন চালের কেজি ২০ টাকা তখন তা শহরে ৫০ টাকা হয় কীভাবে? জানি আপনারাও বলবেন যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচপাতির জন্য এ মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে । তবে এটি কোনো যুৎসই কারণ নয় বরং এর পিছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করে, যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে অধিক মুনাফা লোটে ।
প্রিয় সুধী
এসব লুটেরা আজ ক্ষেত্রবিশেষে বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কোথাও দাদন ব্যবসায়ী । যেভাবেই হোক চাই টাকা আর টাকা । আর এদের সঙ্গে যুক্ত হয় তথাকথিত রাজনীতিক নেতা, মজুতদার, দলবাজ আর চাঁদাবাজরা । মানুষ গোল্লায় যাক-মুনাফাই মুখ্য । অথচ পবিত্র হাদিসে রয়েছে— ‘ব্যবসায়ীরাই আল্লাহর কাছে অতি মর্যাদাবান।’
সম্মানিত সুধী
সমস্যা শুধু এখানেই নয় বরং ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে প্রায় ১৬ কোটি লোকের অন্ন-বস্ত্রের অভাব নেই । কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ আজও সম্ভব হয়নি । কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘদিন ধরে প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাও নেই । ফলে এক্ষেত্রে নষ্ট, অপচয় কিংবা ক্রয়মূল্যে বিক্রি হয় । এরই দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিতে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটতে বাধ্য । এছাড়াও সরকারের পর্যাপ্ত গবেষণা কিংবা বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, রেলের ভাড়া বৃদ্ধি, পাসপোর্টের ফি বৃদ্ধি, ভ্যাট বৃদ্ধি, হুট করে সকল সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সিদ্ধান্তও পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে উকিয়ে দেয় ।
প্রিয় সুধী
এছাড়া হরতাল, অবরোধ নানা রাজনীতিক কর্মকাণ্ড দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে । অন্যদিকে, দিন দিন মানুষের আয়েশি জীবনের প্রতি ঝোঁক, কর্মবিমুখতা, উৎপাদনহীনতা কিংবা অশুভ প্রতিযোগিতা মূল্যবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে ।
সম্মানিত সুধী
ভোক্তার অধিকার আজও সুরক্ষিত হয়নি, ফলে ক্রেতা সাধারণ জানতেই পারে না কীভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় । তাই তো এটি প্রায় প্রবাদের মতো প্রচলিত হয়েছে- ‘আজকাল ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে যেতে হয়, আর পকেট ভরে বাজার আসে। সত্যি এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অর্থনীতিকদের মতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে । নিজ দেশ থেকে পাচারকারী চক্র আরও অধিক লাভের উদ্দেশ্যে পণ্যসামগ্রী অন্য দেশে পাচার করবে।
প্রিয় সুধীমণ্ডলী
আমি আর আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না; বরং এ প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ওপর আমাদের বাঙালি সন্তান নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বক্তব্য থেকে বিষয়টি উপস্থাপন করছি, ‘এ দুর্ভিক্ষের কোনো প্রাকৃতিক কারণ ছিলো না, বরং মনুষ্যসৃষ্ট কারণই মুখ্য।’
সম্মানিত সুধী
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে প্রাকৃতিক কারণকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই; কিন্তু আমাদের দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ষোলআনাই মানুষের তৈরি। এ জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে হবে । এজন্য প্রথমত সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, তারপর জনগণ। ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও সরবরাহকারী সকলেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সন্তান । তাদের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিকগুলো উপস্থাপন করে সকলের সহায়তা ও প্রচেষ্টায় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে । আর দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে জনজীবনে ফিরে আসবে শান্তি-সমৃদ্ধি। এ আশাবাদ ব্যক্ত করে— আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক প্রীতি ও ভালোবাসা জানিয়ে আজ এখানেই শেষ করছি । সবাইকে ধন্যবাদ ।
Leave a comment