ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। অপরদিকে নবাব নিজামত (শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব) লাভ করেন। মােগল আমলে সরকারি ক্ষমতা দু-ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা—দেওয়ানি (রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলা) ও নিজামত (শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারি মামলার দায়িত্ব)। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিকে দেওয়ানি প্রদানের মাধ্যমে স্থির হয় বাংলায় মােগল বাদশাহের দেওয়ানের দায়িত্ব পালন করবে কোম্পানি আর নবাবের হাতে থাকবে নিজামত-এর দায়িত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কোম্পানি মনােনীত রেজা খানের হাতে কোম্পানি দেওয়ানি ও নবাব নিজামত-এর দায়িত্ব অর্পণ করেন। বাংলার শাসনে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে কোম্পানি, নবাব হন নামমাত্র শাসক। এই অঞ্চলে একই সাথে এই দুই ধরনের শাসনকাঠামােকে দ্বৈত শাসন বা ‘Dual system of administration’ বলা হয়। দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানি পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব।

স্বরূপ: দেওয়ানি লাভের আগেই কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে ২৪ পরগনা জেলা এবং মিরকাশিমের কাছ থেকে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের পর বাংলার অবশিষ্ট অংশে রেজা খানকে কোম্পানি নায়েব দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে। রেজা খানকে পরিচালনার জন্য রায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে তার সহকারী হিসেবে কোম্পানি নিযুক্ত করে। অপরদিকে মুর্শিদাবাদ দরবার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস মাইকাসের ওপর। এইভাবে বাংলায় কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে দেওয়ানি ও নিজামিত ক্ষমতার বিভাজন ঘটে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় একদিকে রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলা বিচারের অধিকার লাভ করে। অন্যদিকে, নবাব নিজামত (প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা) লাভ করে অর্থাৎ কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও শাসন পরিচালনা উভয় ক্ষমতাই লাভ করে। এ ধরনের দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় বাংলার সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জনজীবন ভেঙে পড়ে। এ প্রসঙ্গে রিচার্ড বাউচার একটি চিঠিতে লিখেছেন— “অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী শাসনেও যে দেশ সমৃদ্ধ ছিল, তা এখন ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।”

[1] শিল্পবাণিজ্যের ধ্বংসসাধন: দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকারকে কাজে লাগিয়ে বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়াভাবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের ধ্বংসসাধন ঘটে। রবার্ট ক্লাইভ বলেছেন—আমি শুধু এটুকু বলেছি যে, পৃথিবীর আর কোনাে দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ণ, শােষণের ঘটনা কেউ শােনেনি বা দেখেনি—যা হয়েছিল এই দেশে।

[2] কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি: কোম্পানি দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার পেলেও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ না করে তা দেশীয় কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত করে। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থাৎ ইজারাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে চড়া হারে রাজস্ব আদায় শুরু করে। রাজস্ব প্রদানে অক্ষম কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে।

[3] কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সুযােগে কোম্পানির কর্মচারীরা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা স্বনামে ও বেনামে বিল অব এক্সচেঞ্জ, বাঁধ-সেতু-রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে।

[4] ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈত শাসনের কুফল হিসেবে বাংলাতে মর্মান্তিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বঙ্গাব্দ ১১৭৬ ইংরেজি ১৭৭০ খ্রি.) দেখা দেয়। প্রথমে অনাবৃষ্টির কারণে শস্যহানির ফলে এই দুর্ভিক্ষ ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুর শাসননীতির জন্য তা বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।

মন্তব্য: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পেয়েছিলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। ইতিহাসবিদ জন কের মতে, “দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল এবং দুর্নীতিকে আরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলে।” অবশেষে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটান।