দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একদিকে থাকে সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তােলার জন্য এই দুই রষ্ট্রজোটের মধ্যে যে গােপন লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত।
ঠান্ডা লড়াইয়ের পটভূমি/ঠান্ডা লড়াই উদ্ভবের পরিস্থিতি
[1] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী পর্যায়: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লবকে দমন করার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগোেষ্ঠী (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান) জারতন্ত্রের সমর্থনে রাশিয়ায় সেনা পাঠায়। সমাজতন্ত্রকে সুচনাকালেই শেষ করে দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাজেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বে “দ্বিমেরুকরণ রাজনীতির জন্ম হয়।
[2] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর্যায়
-
দ্বিতীয় রণাঙ্গনের ভূমিকা: যুদ্ধ চলাকালে জার্মানির প্রবল আক্রমণে দিশাহারা সােভিয়েত রাশিয়া পশ্চিম জোটের কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরােপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খােলার অনুরােধ রাখে। কিন্তু এই অনুরােধকে নিয়ে চার্চিলের দুমুখাে নীতি স্টালিনকে কুদ্ধ করে তােলে।
-
পটসডাম সম্মেলন: জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সােভিয়েত ও মার্কিন মতবিরােধ প্রকট হয়ে ওঠে। পটসডাম সম্মেলন থেকেই ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্যে আসে।
[3] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়
-
চার্চিলের ফালটন বক্তিতা: ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে (১৯৪৬ খ্রি., ৫ মার্চ) বলেন, উত্তর বালটিক সাগরের তীরবর্তী স্টেটিন থেকে দক্ষিণ অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লৌহ যবনিকার (সােভিয়েত) আড়ালে ঢাকা। ফালটন বক্তিতায় চার্চিল রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরােপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।
-
টুম্যান নীতি: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় (১৯৪৭ খ্রি., ১২ মার্চ) তুরস্ক ও গ্রিস-সহ বিশ্বের যে-কোনাে দেশকে সােভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন, যা টুম্যান নীতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েস্টার ট্রুম্যান নীতিকে ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা বলে অভিহিত করেছেন।
-
মার্শাল পরিকল্পনা: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী জর্জ মার্শাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরােপে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা পেশ করেন, যা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ইউরােপে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা নিয়ে টুম্যান নীতির পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপিত হয় এই মার্শাল পরিকল্পনা। ফলে আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই।
-
কেন্নানের বেষ্টনী তত্ব: রাশিয়ায় কর্মরত প্রাক্তন সহকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, মি. এক্স ছদ্মনামে আমেকিার ফরেন অ্যাফেয়ার্স নামে পত্রিকায় এক প্রবন্ধে সােভিয়েতের আক্রমণাত্মক নীতি প্রতিহত করার জন্য এবং সােভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ‘বেষ্টনী তত্ত্ব’ (১৯৪৭ খ্রি., ৪ জুলাই) প্রকাশ করেন, যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়।
-
সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে আর্থিক সহায়তা পরিষদ গঠন: সােভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে কমিকন (COMECON বা Council for Mutual Economic Assistance) নামে একটি আর্থিক সহায়তা পরিষদ। মার্শাল পরিকল্পনার প্রত্যুত্তর হিসেবে কমিকন গঠিত হয়েছিল।
-
আমেরিকার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন: সােভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তােলে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (NATO)। তারপর একে একে গড়ে তােলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO); মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা (MEDO) [পরবর্তীকালে এটির নাম হয় মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা (CENTO)]; ‘অ্যানজাস (ANZUS) ইত্যাদি শক্তিজোট।
-
রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন: আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পশ্চিম সামরিক শক্তিজোট ন্যাটোর জবাবে রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলিকে (পােল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বালগেরিয়া, আলবানিয়া ও পূর্ব জার্মানি) নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা (Warsaw Pact Organisation, WPO), যা ছিল একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
Leave a comment