সূচনা: ইউরােপের মাটিতে ইউরােপীয় দেশগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই সুযােগে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নেয়।

[1] চিনে আক্রমণ

  • সূচনা: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ জুড়ে জাপানি সেনারা চিনে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। জাপানের সেনাবাহিনী চিনের পিকিং শহরের দক্ষিণে মার্কোপােলাে সেতুর কাছে অবস্থানরত চিনা সেনাদের আক্রমণ করে। পিকিং শহরের সীমান্তবর্তী লুকো-চিয়াও (Luko-Chiao) নামে গ্রামটিতে শুরু হয় চিনা ও জাপানি সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ (১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই)।

  • অধিকার প্রতিষ্ঠা: জাপানি সেনারা পিকিং ও তিয়েনসিন এই দুটি শহরের দখল নেয়। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে সাংহাই, নানকিং, পিকিং, ক্যান্টন এবং উয়ান থেকে সেচুয়ান পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডের ওপর জাপান নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

[2] এশিয়ার বিস্তার নীতির বৃহত্তর পরিকল্পনা: ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ জাপান এশিয়াতে জাপানি সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে বৃহত্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জাপানের এই পরিকল্পনার নাম ছিল ‘বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া যৌথ অগ্রগতি বলয়’ (The Greater East Asia Co-prosperity Sphere)। শিরটোরি তােসিও নামে জাপানের এক প্রভাবশালী আমলা সর্বপ্রথম এই নীতি উত্থাপন করেন। এই পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ ঘটান জাপানের বিদেশমন্ত্রী মাৎসুওকা (Matsuoka)। এই পরিকল্পনার মূল কথা ছিল—জাপান কেবলমাত্র মাঞ্কুয়াে এবং চিনের মধ্যে জাপানি সম্প্রসারণবাদকে আটকে রাখবে না। সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও তার সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাবে।

[3] জার্মান সাহায্য

  • জাপ-জার্মান মিত্রতা: এশিয়াজুড়ে সফলভাবে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের লক্ষ্যে জাপানি মন্ত্রীসভার এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন আয়ােজিত হয়। এই সম্মেলনে (১৯৪০ খ্রি., ১৯ জুলাই) জাপ-জার্মান মিত্ৰতাকে আরও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নেওয়া হয়। এশিয়া মহাদেশে ইঙ্গ-ডাচ-ফরাসি-পাের্তুগিজ উপনিবেশগুলির ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এশিয়ায় জাপানি বিস্তার নীতিকে সমর্থন জানায় জার্মানি। এক্ষেত্রে জার্মানির উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার রণাঙ্গনে ব্রিটেন ব্যস্ত থাকলে ইউরােপে জার্মানির বিরুদ্ধ পক্ষ মিত্রশক্তিজোটের দুর্বলতা বাড়বে।

  • ত্রিপাক্ষিক সামরিক চুক্তি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটলে জাপান ইটালি ও জার্মানির সঙ্গে ‘রােম বার্লিন-টোকিও চুক্তি (১৯৪০ খ্রি., ২৭ সেপ্টেম্বর)-তে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি ‘ত্রিপাক্ষিক অক্ষ চুক্তি’ (Tripartite Axis Pact) বা ‘অ্যান্টি কমিন্টার্ন চুক্তি’ নামেও পরিচিত। এই চুক্তির পরেই জাপান একে একে সুমাত্রা, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিনস, বাের্নিয়াে এবং জাভায় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বন্দরগুলি ধ্বংস করে দেয়।

  • বিভিন্ন অঞ্চল দখল: সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করে জাপান একের পর এক শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), হংকং, মালয়, সিঙ্গাপুর, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ (ইন্দোনেশিয়া) দখল করে।

[4] ইন্দোচিনে অনুপ্রবেশ

  • কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকাকালীন জাপান ফরাসি নিয়ন্ত্রিত ইন্দোচিনে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পতন ঘটলে জাপান ইন্দোচিনে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

  • ভিয়েতমিনদের বিরােধিতা: হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা চলাকালীন আন্নাম, টংকিং, কোচিন-চিন একজোট হয়ে ভিয়েতনাম নামে এক স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। হাে-চি-মিন ভিয়েতনামি মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ‘ভিয়েতমিন’ (Vietminh) বা ‘ভিয়েতনামি স্বাধীনতা লীগ’ (League for Vietnamese Indepen dence)। এই মুক্তিযােদ্ধারা ইন্দোচিনকে জাপানিদের হাত থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রবল সংগ্রাম শুরু করে।

  • ইন্দোচিন ত্যাগ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিজোট শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়। জাপান আত্মসমর্পণ করে। ফলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে জাপান সরে আসতে বাধ্য হয়।

উপসংহার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষপর্বে (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি রণকৌশলের বদল ঘটে। জাপান বিস্তার নীতির পরিবর্তে আত্মরক্ষানীতি গ্রহণ করে।