সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরােপের শক্তিশালী দেশগুলির অন্যতম রাশিয়া চেয়েছিল পূর্ব ইউরােপে পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে সাম্যবাদের বিস্তার ঘটাতে।
[1] রূশ-জার্মান দ্বন্দ্বের মাধ্যমে: তিনের দশকে নাৎসি জার্মানি পূর্বদিকে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করলে ওইসমস্ত রাজ্য জার্মানির পদানত হয়। এইভাবে জার্মানির মুখােমুখি দাঁড়িয়ে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে রাশিয়া শঙ্কিত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে রাশিয়ার লালফৌজই সমগ্র পূর্ব ও মধ্য ইউরােপকে জার্মানির কবলমুক্ত করে ওইসব অঞ্চলে সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
[2] সােভিয়েত রাষ্ট্রজোট গঠনের দ্বারা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রাশিয়া সরাসরি নিজের অঙ্গীভূত করে নেয়। এরপর পূর্ব ইউরােপের যুগােশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, বালগেরিয়া, আলবানিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, পােল্যান্ড ও পূর্ব জার্মানি—এই আটটি দেশকে রাশিয়া কমিনফর্মের অন্তর্ভুক্ত করে।
[3] সােভিয়েতের উদ্দেশ্য: পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে সােভিয়েত তথা রাশিয়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেসমস্ত উদ্দেশ্যে তা হল-
-
সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিস্তার ঘটানাে: বিশ্বের সর্বত্র সাম্যবাদী ভাবধারা বিস্তারের লক্ষ্যে পূর্ব ইউরােপের ওপর রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপনের প্রয়ােজন ছিল।
-
শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব: ইউরােপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযােগ রাশিয়াকে পূর্ব ইউরােপে আধিপত্য বিস্তারে উৎসাহিত করে।
-
নিরাপত্তা-বলয় গঠন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নির্দেশে জার্মান সেনা রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হেনেছিল। কাজেই যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও নিরাপত্তার তাগিদে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে একটি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তােলা সােভিয়েতের কাছে খুবই জরুরি ছিল।
-
আর্থিক পুনবুজ্জীবন: নিজের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য সম্পদ আহরণ এবং নিজস্ব শিল্পজাত পণ্যের বাজার হিসেবেও পূর্ব ইউরােপ রাশিয়ার কাছে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
-
জোটবদ্ধতা: প্রাক্-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কূটনৈতিক দিক থেকে রাশিয়া যে বিচ্ছিন্ন ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে সে একটি নিজস্ব জোট গড়ে তুলতে উৎসাহী ছিল।
[4] পূর্ব ইউরােপে রুশিকরণের পদ্ধতি: পূর্ব ইউরােপকে রুশিকরণ করতে রাশিয়া পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। সেগুলি হল-
-
রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন অস্থায়ী সরকার গঠন: প্রথমে রাশিয়া পূর্ব ইউরােপের বেশ কিছু দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে ফ্যাসিবাদী’, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি আখ্যা দিতে শুরু করে। তারপর সেখানে পপুলার ফ্রন্ট নামে সর্বদলীয় একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারকে এমনভাবে গড়া হয়, যাতে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কেবল সােভিয়েত কমিউনিস্টদের হাতে থাকে।
-
অ-কমিউনিস্টদের উৎখাত: এর পরের স্তরে সেখানে অ কমিউনিস্ট গােষ্ঠীগুলিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় উৎখাত করে মন্ত্রীসভার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ—বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতর কমিউনিস্টদের অধীনে আনা হয়।
-
একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা: সেখানে সমস্ত অ-কমিউনিস্ট মন্ত্রীদের বিতাড়িত করে কমিউনিস্টদের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
-
নতুন শাসনতন্ত্র রচনা ও প্রবর্তন: দেশগুলিতে রাশিয়ার অনুকরণে একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করে নিয়ন্ত্রিত গণভােটের মাধ্যমে সেই শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়।
-
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল: এইভাবে সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি বিরােধী দলগুলিকে দমন করে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা দখল করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, যানবাহন, ধর্মস্থান, সংবাদপত্র, এমনকি ব্যক্তিস্বাধীনতা সমস্ত কিছুর ওপর দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
[5] পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত নিয়ন্ত্রিত কাঠামাে: পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত-অনুগত রাষ্ট্রগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে বজায় রাখতে রাশিয়া যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে গড়ে তুলেছিল তার দুটি দিক ছিল- অর্থনৈতিক ও সামরিক। আসলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে আমেরিকার মার্শাল পরিকল্পনার প্রলােভন থেকে রক্ষা করে সেখানে সাম্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যই রাশিয়াকে এরকম একটা শক্ত পরিকাঠামাে গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল।
উপসংহার: মার্কিন পুঁজিবাদের প্রসার রােধ করে সাম্যবাদী জোটকে অক্ষত রাখার লক্ষ্যেই মূলত রাশিয়া পূর্ব ইউরােপে প্রাধান্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়।
Leave a comment