দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অর্থ হল দুটি পরিষদ নিয়ে গঠিত আইনসভা। অধ্যাপক ফাইনার বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে এবং সংবিধানের জনপ্রিয় নীতির প্রাধান্য নিয়ন্ত্রণের জন্যই আইনসভা দ্বিকক্ষ হয়ে থাকে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রথম কক্ষকে বলা হয় নিম্নকক্ষ – এর সদস্যরা জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোট দ্বারা নির্বাচিত হন। আর দ্বিতীয় কক্ষ বলা হয় উচ্চকক্ষ। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রথম চালু হয় ব্রিটেনে। তারপর বিভিন্ন দেশে তা সম্প্রসারিত হয়। ইংল্যান্ডে যেহেতু এই ধরনের আইনসভা প্রথম চালু হয় তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পৃথিবীর আইনসভার জননী (Mother of the Parliament) বলে আখ্যায়িত করা হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্য বৃন্দ পরােক্ষভাবে অথবা মনােনয়নের দ্বারা নির্বাচিত হন। যেমন ভারতের লােকসভা (নিম্নকক্ষ) ও রাজ্যসভা (উচ্চকক্ষ)। যাঁরা আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়া উচিত বলে মনে করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, লেকি, হেনরি মেইন, লর্ড অ্যাক্টন, গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ। আর যাঁরা মনে করেন যে, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়া উচিত নয় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— বেন্থাম, আবে সিয়ে, ল্যাস্কি, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি

(১) ত্রূটিমুক্ত আইন প্রণয়ন: আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে সুচিন্তিত আইন প্রণীত হয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর দরুন— (a) দুটি কক্ষ থাকলে যুক্তি ও আবেগের অপেক্ষা কার্যকরী হয়ে সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন করতে পারে। (b) দুটি কক্ষ থাকলে সিদ্ধান্তে আসতে সময় লাগায় সাময়িক আবেগ বা উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আইনের রচনায় যুক্তি ও প্রজ্ঞা মুখ্য ভূমিকা নেয়। ব্লুন্টসলির মতে, দুই চোখের তুলনায় চার চোখ বেশি কার্যকরী।

(২) স্বৈরাচারিতা রাধে: দ্বিতীয় কক্ষের উপস্থিতি প্রথম কক্ষের স্বৈরাচার প্রতিরােধ করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করে। দ্বিতীয় কক্ষ সরকারের অত্যাচার থেকে জনগণকে রক্ষা করে। একটি কক্ষের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হলে তা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। লর্ড ব্রাইস বলেছেন, একটি কক্ষের ঘৃণ্য, অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। দ্বিতীয় কক্ষ প্রথম কক্ষের স্বৈরাচারিতা রােধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক গেটেল বলেছেন, স্বাধীনতা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অনেকাংশে সুরক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা হল দ্বিতীয় কক্ষের উপস্থিতি (“The existence of the second chamber is a guarantee of liberty as well as to some extent of safeguard against tyranny.”)

(৩) জনমতের গতি প্রকৃতির প্রতিফলন: কোন কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক মনে করেন যে, আইনসভার দুটি কক্ষ থাকলে জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন ঘটে। এ ছাড়াও আইনসভার দুটি কক্ষের নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হওয়ায় পরিবর্তনশীল জনমতের গতিপ্রকৃতির প্রতিফলন আইনসভায় দেখা যায়।

(৪) জ্ঞানীগুণীদের প্রতিনিধিত্ব: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষ প্রতিনিধিত্বের সুযােগ দেওয়া সম্ভব হয়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় কক্ষ রাজ্যসভায় বহুদিক থেকে প্রতিভাবান (সাহিত্য, ক্রীড়া, সংগীত, বিজ্ঞান, সমাজসেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রের) পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব দেখা যায়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির মনোনীত করে তাদের প্রজ্ঞাকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানাে যায়।

(৫) সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় পরােক্ষ নির্বাচন ও মনােনয়নের ব্যবস্থা থাকায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় তাদের মধ্য থেকে যথাযথ প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় এবং আলােচনার পথ খােলা রেখে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি খুব সহজেই এড়ানাে যায়।

(৬) রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নের সময় যে তর্ক বিতর্ক হয়, তা গণমাধ্যম মারফত প্রচারিত হওয়ায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার ঘটে। উচ্চকক্ষ যে-কোনাে বিলকে পুনর্বার বিচারবিবেচনার সুযােগ পায় ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাসহ সকল বিষয় দ্বিতীয়বার পর্যালােচনা করা যায়, ফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে।

(৭) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উচ্চকক্ষ অপরিহার্য: যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে কেন্দ্র ও রাজ্যের সমন্বয়সাধনের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অপরিহার্য। অনেকের মতে, বহু জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি ও জন সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য দ্বিতীয় কক্ষ অপরিহার্য।

(৮) জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয়: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয় সম্ভব নয়। কিন্তু আইনসভা যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয় তাহলে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের সার্থক সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত উচ্চকক্ষের সদস্যবৃন্দ প্রাদেশিক স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে এবং জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত নিম্নকক্ষের সদস্যবৃন্দ জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। উচ্চকক্ষের সম প্রতিনিধিত্বের নীতি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এ) গ্রহণ করা হয়। ছােটো-বড়াে সকল প্রদেশেই সমপ্রতিনিধিত্বের আঞ্চলিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

(৯) বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অংশগ্রহণের সুযোগ: জ্ঞানীগুণী মানুষেরা নির্বাচনে অংশ নিতে চান না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষে তাদের মনােনীত করে তাদের প্রজ্ঞাকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগানাে যায়। আইনসভা দ্বিকক্ষ হলে আইনসভার উচ্চকক্ষে মনােনয়নের মাধ্যমে বা পরােক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জ্ঞানীগুণী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া যেতে পারে।

(১০) কাজের চাপ হ্রাস: আধুনিক বিশ্বে আইনসভার কাজের চাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। দুটি কক্ষের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করলে কাজের চাপ হ্রাস পাবে। জনকল্যাণকর কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি

(১) অগণতান্ত্রিক: গণতন্ত্রে আইনসভা গঠিত হয় জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। কিন্তু দ্বিকক্ষের সদস্যরা সকলে পরােক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির দ্বারা নির্বাচিত বা মনােনীত হন। যেমন – ইংল্যান্ডের উচ্চকক্ষ লর্ডসভার সদস্যগণ সকলেই মনােনীত সদস্য। এই কারণে অনেকে মনে করেন যে, এই পদ্ধতি থাকার ফলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘিত হয়। তাই তাদের মতে, উচ্চকক্ষের গঠন অগণতান্ত্রিক – যা প্রথম কক্ষেরই সমান্তরাল হবে।

(২) অনাবশ্যক ও ক্ষতিকর: বিখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত আবে সি৺য়ে বলেছেন যে, দ্বিতীয় কক্ষ যদি প্রথম কক্ষের সঙ্গে একমত হয় তবে তা অনাবশ্যক, আর যদি একমত না হয় তবে তা অনিষ্টকর। উচ্চকক্ষ যদি নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় তাহলে উচ্চকক্ষের অস্তিত্ব নিরর্থক হয়ে পড়ে। এর জন্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে আইনসভার একটিমাত্র কক্ষ থাকলেও অসুবিধা হবে না।

(৩) প্রকৃত জ্ঞানীগুণীদের উপেক্ষা: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রকৃত জ্ঞানীগুণীদের জায়গা দেওয়া হয়, এ যুক্তি সর্বাংশে ঠিক নয়। বাস্তবে দেখা যায়, যে দল নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের সদস্য বা প্রতিনিধিদেরই সুযােগ দেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ প্রকৃত জ্ঞানীগুণীরা সুযােগ পান না।

(৪) প্রগতিবিরােধী: অনেকক্ষেত্রে কেবলমাত্র বিরােধিতার কারণে জনকল্যাণমূলক ও প্রগতিশীল আইন প্রণয়নে দ্বিতীয় কক্ষ অহেতুক জটিলতা এবং বাধার সৃষ্টি করে, যা প্রগতিবিরােধী। দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতার অধিকারী হলে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে অযথা বিলম্ব দেখা যায়।

(৫) সময়ের অপচয় ও ব্যয়বহুল: এককক্ষ যদি মনােযােগ সহকারে আইন প্রণয়ন করে তবে দ্বিকক্ষের প্রয়ােজন হয় না। অনেক সময় উচ্চকক্ষ কোনাে আইনকে অযথা দীর্ঘকাল আটকে রাখে। এর ফলে সময়ের অপচয় হয়। আবার, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকলে তার জন্য রাষ্ট্রের কোশাগার থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এই অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ যদি দেশের গরিব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা যায় তাহলে দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।

(৬) সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় অপারগ: সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অত্যাবশ্যক নয়। কারণ দ্বিতীয় কক্ষ থাকলেই সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের সুযােগ থাকবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ দ্বিতীয় কক্ষের প্রতিনিধিত্বও প্রধানত দলীয় ভিত্তিতে হয়ে থাকে।

(৭) জরুরি সময়ে আইন প্রণয়নে অহেতুক বিলম্ব ঘটে: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নে দুটি কক্ষের ভূমিকা থাকায় জরুরি প্রয়ােজনে তাড়াতাড়ি আইন প্রণয়ন কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এই কারণেই দ্বিতীয় কক্ষ অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়। ল্যাস্কির মতানুসারে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কক্ষে অকারণ বিলম্বের সৃষ্টি হয়।

(৮) ক্ষমতাগত সমস্যা: ক্ষমতাগত দিক থেকেও সমালােচকরা দ্বিতীয় কক্ষের বিরােধিতা করেছেন। তাদের মতে, উভয় কক্ষের ক্ষমতা সমান হলে আইনসভা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের শিকার হবে, যদি দ্বিতীয় কক্ষের ক্ষমতা বেশি হয় তবে তা গণতান্ত্রিক হবে।

(৯) স্বৈরাচারিতা রােধের উপযােগী নয়: নিম্নকক্ষ স্বৈরাচারী হলে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরােধী দল আন্দোলন সংঘটিত করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি জনমানসে তার প্রতিফলন ঘটায়। সচেতন জনগণই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটায়। তার জন্য দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়ােজন হয় না।

(১০) জনগণের ইচ্ছা বিভক্ত হতে পারে না: কোনাে কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন আইনসভার দুটি কক্ষ থাকা উচিত নয়। কারণ জনগণের ইচ্ছা দুটিরূপে প্রকাশিত হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কলিন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বিপরীতমুখী গতিযুক্ত ঘােড়া ও ঘােড়ার গাড়ি হিসেবে ব্যঙ্গ করেছেন।