দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি বিশ্ববীক্ষ্যা:

সর্বপ্রথম মার্কসবাদের মাধ্যমেই বিজ্ঞান ও দর্শন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে মার্কসবাদকে বলা হয় বস্তুবাদী দর্শন। মার্কসবাদে বস্তুবাদের সাহায্যে মানবসমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তার জগতটিকেও বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে তাঁদের চিন্তা ভাবনাকে প্রকাশিত করেছেন। এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটিকেই বলা হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। প্রকৃত প্রস্তাবে এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি হল একটি বিশ্ববীক্ষ্যা (World view)। বুরলাট্‌স্কি (Fyodor Burlatsky) এ প্রসঙ্গে তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It has a sophisticated and scientifically based methodology-dialectical and historical materialism that is the basis for studying political processes, phenomena and events.” মানবসমাজ ও মানুষের বৈষয়িক জীবন বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কস-এঙ্গেলস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে প্রয়োগ করেছেন। বুরলাস্কির অভিমত হল: “A materialistic approach to the study of politics means to apply the laws of dialectics, of historical materialism, to the cognition of political phenomena….”

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর সমগ্র মার্কসীয় দর্শন প্রতিষ্ঠিত। সাধারণভাবে দ্বান্দ্বিকতার অর্থ হল বিরোধসমূহের মিলনতত্ত্ব (the theory of the union of the opposites.)। ‘Dialectic’ এই ইংরেজী শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘Dialego’ থেকে। এই গ্রীক শব্দটির অর্থ আলাপ-আলোচনা বা তর্কবিতর্ক। গ্রীক দার্শনিকগণ আলোচনা ও যুক্তির পথে উদ্ভূত বিপরীতকে দূর করে সত্যের সন্ধান করতেন।

মার্কসীয় দর্শন বস্তুবাদী ও দ্বন্দ্বমূলক:

মার্কসবাদ হল একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন। আবার মার্কসবাদ হল একটি দ্বান্দ্বিক বীক্ষণ। সংক্ষেপে মার্কসবাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় হল দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হিসাবে। মার্কসের এই দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একেবারে একটি নতুন ধারা‌ সংযুক্ত করেছে। মার্কস তাঁর রচনায় ‘দ্বান্দ্বিকতা’ (dialectics) ও ‘বস্তুবাদ’ (materialism) কথা দু’টি ব্যবহার করলেও একযোগে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ (dialectical materialism) কথাটি প্রয়োগ করেননি। মার্কসীয় চিন্তা-দর্শনকে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ হিসাবে প্রথম আখ্যায়িত করেন রুশ চিন্তাবিদ প্লেখানভ। এমিল বার্নস বলেছে: “মার্কসীয় দৃষ্টিতে পৃথিবী শুধু বস্তু-সত্যই নয়। তার আরও কতকগুলি ধর্ম বর্তমান। সেগুলির সমষ্টিকে সামগ্রিকভাবে দ্বন্দ্বমূলক সংজ্ঞা দেওয়া যায়।” মার্কসবাদের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ভিত্তি হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। জগৎ সম্পর্কিত প্রশ্নসমূহের মার্কসীয় সমাধান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। এঙ্গেলস (Engels) ল্যুভকি ফয়েরবাখ’ (Ludwig Feverbach) শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “In dialectical materialism the materialist world outlook was taken really seriously for the first time and was carried through consistently…..”

দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ:

স্ট্যালিন (J. Stalin) তার Dialectical and Historical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। মার্কসীয় দর্শন হল দ্বন্দ্বমূলক ও বস্তুবাদী। বস্তু জগতের প্রতি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি হল দ্বন্দ্বমূলক। দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিতে মার্কসবাদে বস্তুজগতের ঘটনা-প্রবাহকে ব্যাখ্যা করা হয়। দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের প্রবহমানতা ও চলমানতাকে মার্কসীয় দর্শনে গ্রহণ করা হয়েছে। মার্কসবাদে দ্বন্দ্ববাদের ভিত্তিতে এই বিশ্বসংসারকে অবিরাম গতি এবং ক্রমবিকাশের মাধ্যমে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আবার বস্তুবাদের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি ঘটেছে মার্কসবাদের মাধ্যমে। বস্তুবাদ বলতে বোঝায় বস্তুজগতের ঘটনা প্রবাহের ব্যাখ্যা এবং সে বিষয়ে ধারণা ও তত্ত্ব। বস্তুবাদে এই জগতকে সামগ্রিকভাবে বস্তু হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বস্তুবাদী তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে বস্তুর মাধ্যমেই সব কিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়। বস্তুবাদ অনুসারে এই বস্তুজগৎ ও তার প্রকৃতিকে অন্তঃস্থল থেকেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সম্ভব। ভাব-কল্পনার সাহায্যে বাইরে থেকে তা বিশ্লেষণ করা যায় না। সুতরাং মার্কসীয় দর্শন হল দ্বন্দ্বমূলক এবং বস্তুবাদী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে মার্কস-এঙ্গেলসের আগেও বস্তুবাদী আলোচনার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে মানবসমাজের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বস্তুবাদকে প্রসারিত করেছেন মার্কস-এঙ্গেলস। তাঁর অবিরাম পরিবর্তন ও ঐতিহাসিক বিকাশের মাধ্যমে বস্তুজগতকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আগেকার বস্তুবাদীরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা বস্তুর অবিরাম পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এবং তাঁরা এই পরিবর্তনকে যান্ত্রিক পরিবর্তন হিসাবেই দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী বস্তুবাদীদের কথা বলা যায়। তবে বস্তুবাদী আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কসের উপর জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়:

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল: এই বস্তুজগৎ হল গতিশীল এবং সদা পরিবর্তনশীল। প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত স্ব-বিরোধ বর্তমান। প্রকৃতির এই অন্তর্নিহিত স্ববিরোধের ফলে বস্তুজগতের পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ বস্তুজগতের এই পরিবর্তন ও বিকাশ হল পরস্পর-বিরোধী প্রাকৃতিক শক্তির ঘাত-প্রতিঘাতের পরিণতি। মার্কসের মতানুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল এই বাহ্যিক জগৎ ও মানুষের চিন্তার গতি সম্পর্কিত সাধারণ বিধির বিজ্ঞান। দ্বন্দ্ববাদের বিধান হল বিশ্বজনীন। এই বিধান সমাজ ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। আবার এই বিধান মানুষের চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তুত গতির বিকাশ ও রূপান্তর সম্পর্কিত যাবতীয় সাধারণ নিয়ম-নীতি দ্বন্দ্ববাদের অন্তর্ভুক্ত।

হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ:

দু’টি পরস্পর-বিরোধী শক্তির সংঘাতজনিত প্রক্রিয়াকে দ্বন্দ্ববাদ বা দ্বান্দ্বিকতা (dialectics) বলে। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা প্রথম বলেন ভাববাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল। প্রাচীনকালের দার্শনিকদের চিন্তাধারার মধ্যেই দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল, হেরাক্লিটাস প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু এই সময়কার জার্মান ভাববাদী দার্শনিকদের হাতে দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব এক পরিশীলিত রূপ লাভ করে। তবে ভাববাদী জার্মান দার্শনিক হেগেলের হাতেই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি পরিপূর্ণতা লাভ করে। মার্কস-এঙ্গেলস-এর মতানুসারে হেগেলই প্রথম দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের মূল নীতিগুলিকে সূত্রবদ্ধ করেছেন। হেগেলের মতানুসারে সবকিছুর বিকাশ তার অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতার ফলেই ঘটে থাকে। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রও হল মানব ইতিহাসের দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়াগত বিবর্তনের সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ ফসল। হেগেল দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাহায্যে মানুষের চিন্তার অগ্রগতি ও বিকাশের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। হেগেল ছিলেন পুরোপুরি একজন ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর মতানুসারে চিন্তার অগ্রগতি ও বিকাশ ঘটে ভাবের দ্বন্দ্বের মাধ্যমে। তিনি ভাব (idea)-কেই প্রাধান্যমূলক বিষয় হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি বস্তু (matter)-র উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি।

মার্কস ও হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ আলাদা:

মার্কস তাঁর দ্বন্দ্ববাদের ক্ষেত্রে হেগেলকে অনুসরণ করেছেন। তবে মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদ হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদ থেকে একেবারে আলাদা। হেগেলীয় দর্শন হল ভাববাদী। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন হল সম্পূর্ণ বস্তুবাদী। তাই মার্কসের দ্বন্দ্ববাদ হেগেলের দ্বন্দ্ববাদের বিপরীত। মার্কস তাঁর Das Kapital গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন: “My dialectic is opposite of Hegel’s.” হেগেলের দ্বান্দ্বিক তত্ত্বে ভাবই হল প্রধান। এবং হেগেলের কাছে ভাবজগতের দৃশ্যমান রূপ বস্তু-জগৎ। পক্ষান্তরে মার্কসের দ্বান্দ্বিক তত্ত্বে প্রাধান্য পেয়েছে বস্তু। মার্কস ভাবকে বস্তুজগতের প্রতিফলন হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। হেগেলের মনন-পদ্ধতি হল ভাবভিত্তিক। হেগেলের কাছে এই মনন-পদ্ধতির মাধ্যমে বস্তুর সৃষ্টি হয়। হেগেলের মতানুসারে ভাবেরই দৃশ্যমান বাহ্য প্রকাশ হল এই বস্তু-জগৎ। অপরদিকে মার্কসের কাছে মানুষের মনে প্রতিফলিত ও রূপান্তরিত বস্তুজগৎই হল ভাব। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ নেতিবাচক (Negative)। হেগেলীয় দর্শন অনুসারেই এক মহাভাব বা চৈতন্যের দ্বান্দ্বিক বিকাশের ফল হিসাবে পার্থিব জগৎ ও জীবনের সতত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। এই দ্বান্দ্বিক বিকাশের প্রকৃতিটি হল নেতিকরণের মাধ্যমে পরিবর্তন ও উন্নতি। হেগেলের অভিমত অনুসারে এই জগৎ ও জীবনের যে কোন স্তর হল ঠিক তার আগেকার স্তরের নেতিকরণ বা অস্বীকৃতি। জগৎ ও জীবনের পরিবর্তন ও বিবর্তন বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কস কিন্তু কেবল এই নেতিকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। মার্কসের মতানুসারে হেগেলের ভাববাদী চিন্তা-দর্শন ও নেতিকরণ প্রক্রিয়ার কারণে তাঁর ইতিহাস দর্শন চূড়ান্ত বিচারে বন্ধ্যা প্রতিপন্ন হয়।

বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব (dialectics) বর্তমান। হেগলীয় দর্শন থেকে এই ধারণাটি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মার্কস দ্বন্দ্বের ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন নতুন এক দ্যোতনা। তার ফলে দ্বান্দ্বিকতা অধিকতর গ্রহণীয় প্রতিপন্ন হয়েছে। বস্তুত মার্কসের হাতে দ্বান্দ্বিকতার মতবাদ নতুন মাত্রাপ্রাপ্ত হয়। মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি হল ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’। এই দুনিয়ার কোন বস্তুই অক্ষয়-অমর নয়। বস্তুজগতের অবিরাম গতি পরিবর্তন, ক্ষয় ও বিকাশ হল মূল সত্য। বস্তুর যেমন বিনাশ ঘটছে, তেমনি ক্রমাগত সৃষ্টি হয়ে চলেছে। সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশ এবং আবার সৃষ্টি এই কর্মকাণ্ডের একটি সূত্র আছে। এই সূত্রটি হল প্রতিটি বস্তুর মধ্যে বৈপরীত্য বা দ্বন্দ্ব বর্তমান। অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে বিপরীতধর্মী সত্তার বা পরস্পরবিরোধী প্রবণতার অস্তিত্ব আছে। আবহমানকাল ধরে এই বস্তুজগৎ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার তিনটি মূল সূত্র বর্তমান। এই তিনটি মূল সূত্র হল: 

  • (১) পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন; 

  • (২) বৈপরীত্যের ঐক্য ও সংগ্রাম এবং 

  • (৩) নেতির নেতিকরণ।

মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদের বৈশিষ্ট্য

‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’-এর শুরুতেই বলা হয়েছে যে, “আজ পর্যন্ত আমরা মানবসমাজের যত ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হয়েছি, সেই সব ইতিহাস হল শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ইতিহাস।” এখানে যে দ্বন্দ্ববাদের কথা বলা হয়েছে তা শুধুমাত্র একটি নেতিকরণ প্রক্রিয়া নয়। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার প্রক্রিয়াটির চারটি মূল নীতি উল্লেখযোগ্য। মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদের এই নীতি বা বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) সকল বস্তু পরস্পর নির্ভরশীল: পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোন বিষয়ের বিশ্লেষণ করা যায় না। প্রকৃতিগতভাবে প্রতিটি বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কিত ও পরস্পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার মূল বক্তব্য হল সামগ্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় ঘটনা ও কাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করা। বস্তুজগতের সকল ঘটনা ও বিষয় পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বস্তুজগতের সকল বস্তু ও ঘটনার মধ্যে প্রকৃতিগত পারস্পরিক সংযোগ বর্তমান। তাই এই বস্তুজগৎ হল সামগ্রিক বিচারে সুসংহত ও অখণ্ড প্রকৃতির। প্রকৃতি বিষয়সমূহের আকস্মিক সমাহারে সৃষ্ট নয়। স্ট্যালিন বলেছেন: “…dialectics does not regard nature as accidental agglomeration of things.”

(২) বস্তুমাত্রেই গতিশীল: বস্তুমাত্রেই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। এই বিশ্ব প্রকৃতির কোন কিছুই শাশ্বত বা চিরন্তন নয় এবং অনড় বা অচল নয়। নতুন বস্তুর জন্ম এবং পুরাতনের ধ্বংস প্রাকৃতিক জগতে সতত ঘটে চলেছে। বস্তুর উদ্ভব ও বিকাশের বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই গতিশীলতা বা পরিবর্তনশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়। তাই মার্কসবাদ অনুসারে সমাজেরও পরিবর্তন ও বিবর্তন স্বাভাবিক। কোন সমাজব্যবস্থাই স্থিতিশীল নয়। পার্থিব জগতের বিষয়সমূহ পরস্পর নির্ভরশীলতা এবং গতিশীলতা ও বিকাশশীলতার দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রকৃতি নিশ্চল নয়, পুরোমাত্রায় সচল। মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন: “Nature is the proof of dialectics and it must be said for modern science that it has furnished this proof with rich materials increasing daily Nature works dialectically and not metaphysically.” স্তালিন বলেছেন: “Nature is not a state of rest and immobility, stagnation and immutability but a state of continuous renewal and development.”

(৩) বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন: দ্বান্দ্বিক নিয়মে প্রগতির ক্ষেত্রে তাৎপর্যহীন অবস্থা থেকে মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। এই মৌলিক পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনও বটে। দ্বান্দ্বিক নিয়মে এক অবস্থা থেকে অন্য এক অবস্থায় আমূল রূপান্তর ঘটে। এ হল এক পর্যায় থেকে অন্য এক পর্যায়ে উল্লম্ফন। বস্তুজগতের বিকাশের ক্ষেত্রে এ হল উন্নত থেকে উন্নততর স্তরে উত্তরণ। মরিস কর্নফোর্থ (Maurice Cornforth) Dialectical Materialism শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The Marxist dialectical method teaches us to understand processes of development in terms of the transformation of quantitative to qualitative changes and to seek the grounds and explanation of such development in the unity and struggle of opposites.” বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় (quantitative change lending to qualitative change)। পরিমাণের সামান্য পরিবর্তনও গুণগত মৌলিক পরিবর্তনে পরিণত হয়। ক্রমবিকাশের ধারায় কোন কিছুর পরিমাণগত পরিবর্তন একটা বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তন ধীরে হয় না। বিশেষ একটা পর্যায়ে উল্লম্ফনের মত অত্যন্ত দ্রুত এই রূপান্তর ঘটে। যেমন, জলের উপর উত্তাপ বৃদ্ধির ফলে এক নির্দিষ্ট অবস্থায় জল বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। আবার উত্তাপ হ্রাসের ফলে এমন এক অবস্থা আসে যখন জল বরফে রূপান্তরিত হয়। একে জলের বৈপ্লবিক রূপান্তর বলা যেতে পারে। এই গুণগত পরিবর্তন সময় সাপেক্ষ। প্রথমে অগ্রগতির ধারা হয় স্বপ্নগতি সম্পন্ন। তারপর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। নতুন কিছুর আবির্ভাব হয়। এইভাবে বস্তুর বিকাশ ঘটে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে মানবসমাজেও এ রকম পরিবর্তন ঘটে। একে বিপ্লব বলে। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে পুরাতন সব কিছুই সামাজিকভাবে বাতিল হয়ে যায় না। পূর্ববর্তী সমাজের যা কিছু নতুন বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু পূর্ববর্তী সমাজের সৃজনশীল এবং গঠনমূলক সবকিছু বজায় থাকে। বিকাশের ধারায় নতুন কালক্রমে পুরাতন প্রতিপন্ন হয় এবং তখন তার পরিবর্তন অপরিহার্য প্রতীয়মান হয়। এই পথে সমাজের পরিবর্তন ঘটে এবং সমাজের বিকাশ সাধিত হয়।

(৪) বস্তু ও ঘটনার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব: প্রত্যেক বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পর-বিরোধী ধর্ম একই সঙ্গে বর্তমান থাকে। তার ফলে বস্তু ও ঘটনার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্যই সকল পরিবর্তন ঘটে। মরিস কর্নফোর্থের অভিমত অনুসারে পরিবর্তনের পিছনে মূল শক্তি হল দ্বন্দ্ব (contradiction is the driving force of change)। সমাজ দ্বন্দ্বহীন হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে লেনিনের অভিমত হল: “The division of unity and the cognition of its contradictory parts is one of the most fundamental features of dialectics, it is indeed, the essence of dialectics.” বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তর হল এই অন্তর্দ্বন্দ্বেরই ফল। প্রত্যেক বস্তুর আভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক শক্তি বা গতির পরিবর্তনের ফলস্বরূপ তার গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। স্ট্যালিন (Stalin)-এর মতানুসারে প্রকৃতির সকল প্রতীয়মান বস্তুর মধ্যে আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য বর্তমান। এই দু’টি শক্তি হল নেতিবাচক ও ইতিবাচক। এই দুই পরস্পর-বিরোধী শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ বস্তুকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও গতিময় করে। স্ববিরোধের এই সংঘর্ষই হল বিকাশ। লেনিন (Lenin) বলেছেন: “Development is the struggle of opposites.” লেনিনের মতানুসারে বস্তুর প্রকৃতিগত ও অন্তর্নিহিত এই স্ববিরোধের আলোচনাই হল দ্বান্দ্বিকতা। তিনি বলেছেন: “In its proper meaning, dialectics are studies of the contradiction within the very essence of things.” আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর প্রত্যেক পর্যায়ে অপরিহার্যভাবে শ্রেণীদ্বন্দ্ব বর্তমান। পুঁজিবাদী সমাজে সর্বহারা ও বুর্জোয়া শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ফলে পুঁজিবাদী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে ; উদ্ভব হবে শ্রেণীহীন, শোষণহীন এক সমাজতান্ত্রিক সমাজের। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হবে। সাম্যবাদী সমাজে মানুষের উপর শাসনের জায়গায় সৃষ্টি হবে বস্তুর উপর শাসন ও উৎপাদন-প্রণালীর গতি-নিয়ন্ত্রণ। এইভাবে প্রত্যেক বস্তু বা ঘটনার পারস্পরিক সংঘাত ও ঐক্যই নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়ার মূল কারণ। দ্বান্দ্বিকতার এই নীতিটিকে বলে ‘struggle and unity of opposites.”

নেতির নেতিকরণ: বিকাশের প্রত্যেক পর্যায়ে পূর্ববর্তী পর্যায়ের মূল অবস্থার অস্বীকৃতি প্রকাশ পায়। পুরাতনের অস্বীকৃতি ব্যতিরেকে নতুনের আবির্ভাব অসম্ভব। মার্কস বলেছেন: “No development can take place in any sphere unless it negates old forms of existence.” পুরাতনের জঠর থেকে নতুনের জন্ম হয়। পুরাতনের অবসান এবং নতুনের আবির্ভাব কেবল বৈপ্লবিক উপায়েই সম্ভব। বিপ্লব মানে কেবল ধ্বংস নয়। এ হল উন্নততর নতুনের আবির্ভাব ও বিকাশ। ক্রমবিকাশের ধারায় বস্তুর অত্যন্ত দ্রুতভাবে বা উল্লম্ফনের মাধ্যমে পুরাতন অবস্থাকে অস্বীকার (negation) করে নতুনের সৃষ্টি হয়। এই নতুন অবস্থার মধ্যেও স্ববিরোধী বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বর্তমান থাকে। তার ফলে একে অস্বীকার করে (negation of negation) এক নতুনতর অবস্থার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ অস্বীকৃতি মানেই কেবল ধ্বংস নয়, এ হল এক নতুন অবস্থায় উন্নততর অগ্রগতি। এঙ্গেলস বলেছেন: “Negation in dialectics does not mean simply saying no.” বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নততর অবস্থার সৃষ্টি ও বিকাশ সম্ভব হয়। এইভাবে একটি ব্যবস্থার অস্বীকৃতির পর যে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব হয় তা পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকে সব সময়ই উন্নততর। এই প্রক্রিয়াকে ‘নেতির নেতিকরণ’ বা ‘অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি’ (negation of negation) বলে। নেতির নেতিকরণ প্রক্রিয়াটিকে মার্কস উদাহরণের সাহয্যে বিন্যস্ত করেছেন। বীজ মাটিতে পুঁতলে গাছ জন্মায়। গাছে ফুল হয় এবং তারপর ফল হয়। ফল থেকে আবার বীজ পাওয়া যায়। বীজ থেকে আবার গাছ হয়। প্রতিটি অবস্থাই নতুন সত্তাযুক্ত। একটি অবস্থা থেকে আর একটি অবস্থা একেবারে আলাদা। বীজকে নেতিকরণের পর গাছ। গাছকে নেতিকরণের পর ফল। একে বলে নেতির পৌনঃপুনিকতা। নেতিকরণের পর আগেকার অস্তিত্বকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী ‘নেতির নেতিকরণের’ প্রক্রিয়া বা ধারা সমাজজীবনেও অব্যাহত। সামন্ততন্ত্রকে ধনতন্ত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না; অনুরূপভাবে ধনতন্ত্রকে সামন্ততন্ত্রের মধ্যে পাওয়া যাবে না। এতদ্‌সত্ত্বেও পূর্বেকার পর্ব-গুলিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বীজকে গাছ অস্বীকার করতে পারে না।

বাদ, প্রতিবাদ ও সম্বাদ: ক্রমবিকাশের এই সূত্রকে ‘বাদ’, ‘প্রতিবাদ’ এবং ‘সম্বাদ’ হিসাবেও প্রকাশ করা যায়। যেমন, সামস্ততান্ত্রিক ব্যবহার অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তাকে অস্বীকার করে উন্নততর ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয়। এ হল ‘বাদ’ (thesis) এর অস্বীকৃতি বা ‘প্রতিবাদ’ (antithesis)। পুনরায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্ববিরোধসঞ্জাত অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তা অস্বীকার করে উন্নততর ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। এ হল ‘অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি’ বা ‘সম্বাদ’ (synthesis)। হান্ট (Carew Hunt) বলেছেন: “The synthesis negates the anti-thesis the first negation and is thus the negation of the negation.”

মূল্যায়ন: মার্কসের দ্বন্দ্ববাদে শুধুমাত্র ভিন্নধর্মী দু’টি শক্তির সংঘাত বা বিরোধিতার কথা বলা হয়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতা হল মূলত পারস্পরিক প্রভাবজনিত এক প্রক্রিয়া। জন লিউইস (John Lewis)-এর মতানুসারে এই দ্বান্দ্বিকতা হল পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (reciprocity) র সূত্রজনিত এক প্রবাহবিশেষ।

মার্কসের দর্শন বস্তুবাদী:

প্রকৃতি ও তার অংশ স্বরূপ মানবসমাজ সম্পর্কে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুবাদ (materialism) হিসাবে গণ্য হয়। মার্কসবাদী বিশ্বদৃষ্টি বা দর্শনই হল বস্তুবাদ। বস্তুবাদ হল একটি বিশেষ দার্শনিক কাঠামো। এখানে পার্থিব জগৎ ও জীবনের বস্তুময়তাকেই প্রাণ ও ভূতির নিদর্শন হিসাবে মনে করা হয়। এই জগৎ ও জীবনের মূল সত্য হল বস্তুময়তা। বস্তুই প্রধান, ভাব বস্তুর অনুগামী। বস্তুময়তারই বিভিন্ন প্রকাশ হল অনুভূতি-আকাঙ্ক্ষা, চেতনা-ভাবনা, মন, সৌন্দর্যবোধ প্রভৃতি গৌণ মানবিক বৈশিষ্ট্যসমূহ। মার্কসের মতে ‘আত্মা’ বা ‘মন’ সবকিছুর নির্ধারক হল বস্তু। বস্তু মন-নিরপেক্ষ। ভাববাদী হেগেল (Hegel) এর মতানুসারে মনই হল আদি সত্তা। বস্তুর যদি আদৌ কোন সত্তা থাকে তা গৌণ। এই পার্থিব জগৎকে ছাড়িয়ে এক শাশ্বত চেতনা ও মহাভাব (Spirit and Idea)-এর জগৎ বর্তমান। সেই জগৎই হল মূল সত্য। আর এই পার্থিব জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন রূপ হল, মূল সত্য যে চেতনা তারই বিভিন্ন প্রকাশমাত্র। এই হেগেলীয় ভাববাদকে মার্কস পুরোপুরি বর্জন করেছেন। মার্কস বস্তুজগতের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে চেতনা সত্তাকে নির্ধারিত করে না, সত্তাই চেতনাকে নির্ধারিত করে (being determines consciousness, not the other way round)। বস্তুজগতের এই প্রাথমিক অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হিসাবে গণ্য হয়।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিভিন্ন দিক

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ হিসাবেও পরিচিত। এই মতবাদ অনুসারে বস্তুই হল প্রকৃতি ও তার ঘটনাবলীর মূল ভিত্তি এবং এই সত্য দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিভিন্ন দিকগুলি আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার।

(১) বস্তু জগতের প্রকৃতি পরিবর্তনশীল: এই জগৎ বা পৃথিবী প্রকৃতিগতভাবে হল পদার্থ বা বস্তু। বস্তু অনড়-অচল নয়— গতিশীল। বস্তু সতত পরিবর্তনশীল। প্রত্যেক বস্তু পরস্পর সম্পর্কিত এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুসারে কোন ঘটনাই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। সমাজজীবনের প্রত্যেক ঘটনা একটা নির্দিষ্ট নিয়মে ঘটে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন শক্তি ও বস্তুর অবস্থানকে বিচার করা দরকার। দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মালিকের শ্রমিক-শোষণ পুঁজিবাদী সমাজের অঙ্গীভূত বিষয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ ব্যতিরেকে এই শোষণের অবসান অসম্ভব। এই কারণে মার্কসীয় ধারণা অনুসারে কোন বিশেষ কারখানার মালিক পুঁজিবাদী শোষণমূলক কাঠামোর ঊর্ধ্বে হতে পারে না।

(২) মানুষের চেতনা, অনুভূতি বস্তুরই প্রতিফলন: মার্কসীয় দর্শনে বস্তুকেই মৌলিক বা মুখ্য বলে মনে করা হয়, মনকে নয়। মানুষের চেতনা, ভাবনা, অনুভূতি প্রভৃতি সবই বস্তুরই প্রতিফলন মাত্র। এগুলি বস্তুকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। বস্তু থেকে এগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এইভাবে বস্তুগত অবস্থার ভিত্তিতেই সমাজজীবনের ধ্যান-ধারণা, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান, মতবাদ প্রভৃতি গড়ে ওঠে।

(৩) মানুষ বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে: মার্কসবাদ অনুসারে বলা হয় যে পার্থিব জগৎ ও তার বিকাশের নিয়ম-কানুন সম্পর্কিত জ্ঞান আয়ত্ত করতে মানুষ সক্ষম। এই জগতের সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান মানুষ এখনও অর্জন করতে পারেনি এ কথা ঠিক। কিন্তু মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিদ্যার অভিজ্ঞতার দ্বারা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বলতে একটি সজীব বহুমুখী জ্ঞানকে বোঝায়। এই জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা ক্রমবর্ধমান।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সমালোচনা:

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সর্বাংশে সমালোচনার ঊর্ধ্বে এমন কথা বলা যায় না। মার্কসবাদ বিরোধীরা এই মতবাদের বিরূপ সমালোচনা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়। তার মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(ক) মানবসমাজে বিভিন্ন ধরনের বহু সমস্যা বর্তমান। এই সমস্ত সমস্যা বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। বস্তুজগতের নিয়মাবলীর সাহায্যে এই সমস্ত সমস্যাদির যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না

(খ) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে এই জগৎ, জীবন ও মানুষের অবস্থানকে পর্যালোচনা করা হয়েছে সর্বহারার চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে। এই মতবাদে সর্বহারার শ্রেণীসত্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। স্ট্যালিনের মতবাদ অনুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল সর্বহারা শ্রেণীর পরিচালক। সমালোচকদের অভিমত অনুসারে সর্বহারার চেতনা সমাজের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সঙ্গীত এবং সাংস্কৃতিক জগতের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে প্রভাবিত করতে পারে।

(গ) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুযায়ী কর্মই হল সব কিছু। কর্মই হল সত্যের নির্ধারক। এই মতবাদে চিত্তা-চৈতন্যের কোন রকম স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভূমিকাকে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু সমালোচকদের মতানুসারে চিন্তা-চৈতন্যও মানুষের কর্মকে প্রভাবিত করে।

(ঘ) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজাতির স্বাধীনতার রাজ্যে উত্তরণের কথা বলা হয়েছে। মানুষের স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই ব্যাখ্যা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়।

উপসংহার: মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কোন বিমূর্ত দার্শনিক তত্ত্ব নয়। এর সাহায্যে বিজ্ঞানের প্রত্যেক ক্ষেত্রে যাবতীয় তথ্য সম্যকভাবে অবগত হওয়া যায়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গভীর তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এই দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাজের অগ্রগতির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয় এবং সমাজের অতীত ও বর্তমান রূপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায় এবং ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা লাভ করা যায়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি রাজনীতিক দর্শন হিসাবে চূড়ান্তভাবে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ তত্ত্বচিত্তার ভিত্তিতে দাসসমাজ, সামন্ত সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ প্রভৃতি সামাজিক বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এমিল বার্নসের মতানুসারে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানভাণ্ডারের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সমাজের বর্তমান রূপটি ছাড়াও সমাজের অতীত ও অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসাবে সমাজের ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়াও মার্কসবাদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মরিস কর্নফোর্থের অভিমত অনুসারে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশৃঙ্খল সামাজিক পরিস্থিতির অস্থির অবস্থায় সামাজিক পরিবর্তন ও বিকাশের সাধারণ নিয়মগুলিকে শৃঙ্খলিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে এবং এ বিষয়ে সঠিক ও সম্যক ধারণাকে বিকশিত করেছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই তাত্ত্বিক ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ বির্তকের ঊর্ধ্বে।