অথবা, মনের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। দেহ ও মনের সম্পর্ক হিসেবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও পূর্ববর্তী শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষ সৃষ্টি। তাই মানুষ অন্যান্য বস্তুর ন্যায় নিছক বস্তু নয়, ব্যক্তিসত্তা এ ব্যক্তিসত্তার দুটি প্রধান দিক রয়েছে, যা অন্য কোনো বস্তুসত্তার নেই। একটি তার দৈহিক দিক বা দেহ এবং অপরটি তার মানসিক দিক বা মন। মনের সাথে দেহের এবং দেহের সাথে মনের সম্পর্ক খুবই গভীর ও নিবিড়। দৈহিক সুস্থত মনে প্রফুল্লতা আনে, আর মানসিক বিষণ্ণতা দেহে প্রতিক্রিয়া ফেলে। দেহ ও মনের এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াবাদ ও পূর্ববর্তী শৃঙ্খলাবাদ আলোচনা করা হলো-
দেহ-মনের প্রকৃতি/স্বরূপঃ দেহ-মন সম্পর্কিত এসব মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আধুনিককালে দর্শনে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেসব দার্শনিক এ বিতর্কে অংশ নেন, তাদের মধ্যে রেনে ডেকার্ট, নিকোলাস ম্যালেবাসে, আর্নল্ড গিউলিনকস, বেনেডিক্ট স্পিনোজা, উইলিয়াম গটফ্রাইড লাইবনিজ, টমাস হাকস্লে প্রমুখ অন্যতম। ডেকার্ট অভিমত প্রকাশ করেন যে, দেহ ও মন পরস্পর দু’টি ভিন্নধর্মী দ্রব্য। দেহের স্বরূপ বিস্তৃতি এবং মনের স্বরূপ চিন্তন। পরস্পর ভিন্নধর্মী দ্রব্য হলেও, ডেকার্টের মতে, দেহ-মনের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দেহ-মনের সম্বন্ধ বিষয়ক ডেকার্টের এ মতবাদ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ নামে পরিচিত। গিউলিনকস ও ম্যালেব্রাসে বিশ্বাস করেন যে, দেহ ও মন দু’টি পৃথক দ্রব্য। এবং পৃথক ও ভিন্নধর্মী দ্রব্য বলেই এদের মধ্যে কোনো কারণিক সম্বন্ধ নেই বা একে অন্যের ওপর কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে সক্ষম নয়। তবে দেহ ও মনের মধ্যে অবশ্যই সম্পর্ক রয়েছে এবং এ সম্পর্ক প্রয়োজন অনুসারে স্থাপিত হয় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নঃ আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক ডেকার্ট হলেন এ মতবাদের সমর্থক। তার মতে, দেহ ও মন একে অন্যের ওপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। কার্টেশিয়ান মতবাদ অনুসারে, দেহ ও মন হচ্ছে দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দ্রব্য। দেহ বিস্তৃতিসম্পন্ন, মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। দেহ চেতনাহীন, মনের চেতনা আছে। দেহ যান্ত্রিক নিয়মের অধীন, আর মন উদ্দেশ্য বা আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং দেহ ও মনের দ্বৈততাই লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু ডেকার্টের মতে, দেহ ও মন সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। জ্ঞানের বেলায় দেহ মনের ওপর কাজ করে, আর কাজ করার সময় মন দেহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কোনোকিছু জানতে গেলে ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর মিলন ঘটে। এ মিলন দেহের স্নায়ুতন্ত্রে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। মন যখন এ উত্তেজনার কারণ নির্দেশ করে ব্যাখ্যা দেয়, তখনই জ্ঞানের সৃষ্টি হয়।
মূল্যায়নঃ ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিষয়ক মতবাদটি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এর ত্রুটিগুলো উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত, ডেকার্টের মতে দেহ ও মন দু’টি বিপরীতধর্মী দ্রব্য। কিন্তু দেহ ও মন বিপরীতধর্মী দ্রব্য হলে এদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদীদের মতে দেহ বিস্তৃতিসম্পন্ন; কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। সুতরাং কি করে বিস্তৃতিহীন মন বিস্তৃতিশীল বস্তুর ওপর ক্রিয়া করতে পারে তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। অতএব, পিনিয়েল গ্রন্থিতে কোন ভৌতিক গুণ নেই, যাতে মন ও দেহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে পারে।
তৃতীয়ত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ স্বীকার করলে বিজ্ঞানসমর্থিত শক্তির অবিনশ্বরতাবাদকে অস্বীকার করতে হয়। সুতরাং ডেকার্টের এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ সন্তোষজনক মতবাদ নয়।
পূর্বপ্রতিষ্ঠিত বা পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদঃ দেহ ও মনের সম্পর্ককে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) খ্রিঃ পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ বা ঐক্যবাদের উল্লেখ করেন। ঈশ্বর সৃষ্টির সময়ই দেহ ও মনের মধ্যে এক শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন। এ শৃঙ্খলা অনুসারে দেহ ও মন পরস্পরের মধ্যে নিত্যসঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে এ সঙ্গতির জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। সৃষ্টির সময় একবার হস্তক্ষেপ করেই ঈশ্বর দেহ ও মনের নিত্যসঙ্গতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লাইবনিজ দেহ ও মনকে দু’টি ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন। এ দু’টি ঘড়ি এমনভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে এরা সবসময়ই একই রকম সময় দিয়ে থাকে।
লাইবনিজ তার চিৎপরামাণুর সাধারণ মতবাদ থেকে দেহ ও মনের সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। জগৎ চিৎপরমাণুতে পরিপূর্ণ হলে দেহ ও মন বাদ পড়ে না। সুতরাং দেহ ও মন উভয়ই চিৎপরমাণুর সৃষ্টি। তবে দেহ কতকগুলো অচেতন পরমাণুর সৃষ্টি। মন এক আত্মসচেতন চিৎপরমাণু বিশেষ। সুতরাং দেহ ও মন একে অন্যের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারে না। সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎপরমাণু দেহ ও মনের চিৎপরমাণুগুলোর মধ্যে সৃষ্টিকালেই শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছে। এ পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার জন্যই যখন মনের চিৎপরমাণুতে পরিবর্তন হয়, সেটা দেহের চিৎপরমাণুতেও ঘটে। অন্যকথায়, পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার জন্য দৈহিক প্রক্রিয়া ও মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সঙ্গতি দেখা যায়।
সমালোচনাঃ পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ নানা কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলোঃ
প্রথমত, দেহ ও মনের সঙ্গতি রক্ষা করার জন্য এ মতবাদে উপলক্ষবাদীদের মত ঈশ্বরের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছে, যা আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। কারণ ঈশ্বরের সাহায্যে দেহ ও মনের সম্বন্ধের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
দ্বিতীয়ত, লাইবনিজ বলেন, কোনো চিৎপরমাণুই অন্য চিৎপরমাণুর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ঈশ্বরকে চিৎপরমাণুর মধ্যে সঙ্গতি স্থাপন করতে হলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর তা পারেন না।
তৃতীয়ত, দেহ ও মনের চিৎপরমাণু যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তাসম্পন্ন হয়, তাহলে তাদের মধ্যে সঙ্গতি স্থাপন করা ঈশ্বরের পক্ষে কীভাবে সম্ভব, এ বিষয়ে লাইবনিজ কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেননি।
চতুর্থত, লাইবনিজ চিৎপরমাণুগুলোকে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার অধীনে নিয়ন্ত্রিত চিৎপরমাণুগুলোর পক্ষে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ও লাইবনিজের দেহ ও মনসম্পর্কিত পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ বলে বিবেচিত হয়। কেননা তিনি (লাইবনিজ) পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদের সাহায্যে দেহ ও মনের সঙ্গতি রক্ষার চেষ্টা করেছেন। তিনি ঈশ্বরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড বলেছেন। তাছাড়া ডেকার্ট যে মতবাদ দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তা সঠিক মতবাদ হিসেবে গ্রহণযোগ্য না হলেও তার প্রচেষ্টা অন্তত প্ৰশংসনীয়।
Leave a comment