প্রশ্নঃ দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যা কর। এ প্রসঙ্গে গ্রীক পরমাণুবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক দেখাও৷
অথবা, দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর। এ প্রসঙ্গে গ্রীক পরমাণুবাদের কোনো সম্পর্ক আছে কি?
ভূমিকাঃ কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করেই দর্শনের উৎপত্তি। আর এই দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে দেহ ও মন সম্পর্কিত সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কোনো দার্শনিক দেহ ও মনকে একটি দ্রব্য হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো দার্শনিক আলাদা দ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে দেহ ও মন একটি দ্রব্য হোক আর দু’টি দ্রব্যই হোক উভয়ই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে একটি মতবাদ হলো ক্রিয়-প্রতিক্রিয়াবাদ।
দেহ ও মনের সম্পর্কঃ দেহ ও মনের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। মানুষ রেগে গেলে তার দৈহিক পরিবর্তনগুলোতে রাগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায় দেহে কম্পন দেখা যায় ইত্যাদি। আবার মস্তিষ্কে কোনো গুরুতর আঘাত লাগলে চেতনাশক্তি লোপ পায়। মস্তিষ্কের বৈকল্য অনেক প্রকার মানসিক রাগের কারণ।
দেহ-মনের প্রকৃতি/স্বরূপঃ ফরাসি দার্শনিক ডেকার্টের সময় থেকে দেহ-মনের প্রকৃতি এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক সর্বপ্রথম দেহ-মনের প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রয়াসী হন। তিনি দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি দ্রব্য বলে মনে করেন। তার মতে, দেহের বিস্তার আছে, কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। মন আধ্যাত্মিক ও প্রজ্ঞাদীপ্ত। মন প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু দেহ জড়ীয়। মানুষের দেহ ও মন দু’টি আলাদা জিনিস হলেও এ দু’য়ের সমন্বয়েই মানুষ। দেহ থেকে মন আলাদা হয়ে গেলে, দেহ হয়ে পড়ে জড় পদার্থ। মনে যদি কাজ করার ইচ্ছা না থাকে তবে দেহ নিশ্চল হয়ে পড়ে। কারণ মানুষ শুধু জড়দেহের অধিকারী নয়, বরং চেতনা, চিন্তন ও কল্পনার অধিকারী। এক মানুষের মধ্যেই দেহ ও মনের আবাসস্থল। তাই ব্যক্তির দেহ ও মনকে কিছুতেই পৃথক করা সম্ভব নয়।.
অপরপক্ষে স্পিনোজা মত প্রকাশ করেন যে, দেহ ও মনের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু এ সম্পর্ক একে অন্যের ওপর কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট নয়। আসলে দেহ ও মন দু’টি সমান্তরাল সরলরেখার মতো পাশাপাশি চলমান। দেহে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলে সমান্তরালভাবে মনেও পরিবর্তন ঘটে এবং বিপরীতক্রমে মনে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলে দেহেও পরিবর্তন দেখা দেয়। দেহ-মনসম্পর্কিত স্পিনোজার এ মতবাদ সমান্তরালবাদ নামে পরিচিত। লাইবনিজ দেহ ও মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এ দু’টি দ্রব্য বা চিৎপরমাণুর মধ্যে পূর্বস্থাপিত সম্পর্ক বিদ্যমান। লাইবনিজের এ মতবাদ দর্শনে পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ নামে পরিচিত। দার্শনিক হাক্সলে দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ক সমস্যাটি জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করেন। তার মতে, মনের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। এটি মস্তিষ্কের তথা দেহের উপবস্তু বিশেষ। দৈহিক ক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে মানসিক পরিবর্তন ঘটে কিন্তু বিপরতীক্রমে নয়। দেহ-মন সম্পর্কিত হাক্সলের এ মতবাদ উপ-বস্তুবাদ নামে পরিচিত।
পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদঃ পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ সম্পর্কিত ধারণা আধুনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজের দর্শনে তথা চিন্তায় লক্ষ করা যায়। তিনি দেহ ও মনের সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েই মূলত এই পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদের কথা বলেন। এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ-
(১) ঈশ্বর কর্তৃক দেহ ও সনের মধ্যে সৃষ্টির সময়েই সঙ্গতি স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, ঈশ্বর সৃষ্টির সময়ই দেহ ও মনের মধ্যে এক শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এ শৃঙ্খলা অনুসারে দেহ ও মন পরস্পরের মধ্যে নিত্যসঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে এ সঙ্গতির জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। সৃষ্টির সময় একবার হস্তক্ষেপ করেই ঈশ্বর দেহ ও মনের নিত্যসঙ্গতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লাইবনিজ দেহ ও মনকে দু’টি ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, দু’টি ঘড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে।অর্থাৎ ঘড়ি দু’টি তৈরি করার সময় তার মধ্যে এমনভাবে শৃঙ্খলা স্থাপন করা হয়েছে যার ফলে দু’টি ঘড়ি আলাদাভাবে অবস্থান করেও একই রকম সময় নির্দেশ করে চলেছে। অনুরূপভাবে দেহ ও মনের মধ্যে ঈশ্বরকৃত পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সাথেই মানসিক পরিবর্তন বা মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে দৈহিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হয়।
(২) চিৎপরমাণু নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্তঃ লাইবনিজের মতে, জগৎ চিৎপরমাণুতে পরিপূর্ণ। তবে এ চিৎপরমাণুগুলোতে চৈতন্য প্রকাশের মাত্রাভেদ আছে। কতকগুলো চিৎপরমাণু অচেতন, কতকগুলো চেতন আবার কতকগুলো আত্মসচেতন। প্রত্যেক চিৎপরমাণুই স্বনির্ভর আত্মকেন্দ্রিক এবং গবাক্ষহীন। এরা পরস্পর প্রভাবমুক্ত। ঈশ্বর হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরমাণু। তিনিই অন্যান্য পরমাণুকে সৃষ্টি করেছেন এবং আগে থেকে এদের ভেতর নিত্যসঙ্গতি প্রদান করেছেন। ফলে এরা নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্ত।
(৩) সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড কর্তৃক শৃঙ্খলা স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাডই অন্য মোনাডগুলোকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করার সময় তাদের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এর ফলে জগতে কোথাও কোনো অরাজকতা বা কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবকিছুই নিয়মশৃঙ্খলা মত চলছে। অর্থাৎ জগতে বিভিন্ন জিনিস আছে, যাদের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও ঈশ্বর কর্তৃক সবকিছু সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এবং সবকিছু সৃষ্টির সময় নিয়ম-শৃঙ্খলা স্থাপন করার কারণেই জগতের সবকিছু শৃঙ্খলা অনুযায়ী, নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলছে। লাইবনিজের এ মতই পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদ বা Preestablished harmony নামে পরিচিত।
সমালোচনাঃ দেহ ও মনের স্বরূপ সম্পর্কিত পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদের যথেষ্ট ত্রুটি লক্ষ করা যায় যা নিম্নরূপ-
(১) বাস্তবতাবিরোধী মতবাদঃ লাইবনিজ বলেন, ঈশ্বর কর্তৃক সবকিছুর মধ্যেই সৃষ্টির সময় সঙ্গতি স্থাপনের কারণে কোথাও কোনো অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা নেই। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখি যে জগতের অনেক বিষয়ের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে আছে। যেমন প্রাকৃতিক কারণেই বন্যা, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি ঘটে থাকে। কাজেই তার এ মতবাদ বাস্তবতাবিরোধী মতবাদ।
(২) ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকারঃ লাইবনিজ তার মোনাডবাদ ব্যাখ্যায় অসংখ্য মোনাডের কথা বললেও পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদের আলোচনা করতে গিয়ে,বলেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড আছে এবং সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাডই ঈশ্বর, যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। এই ব্যাখ্যা দ্বারা মনে হয় যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে তিনি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।
গ্রীক পরমাণুবাদের সাথে লাইবনিজের সম্পর্কঃ গ্রীক পরমাণুবাদের সঙ্গে লাইবনিজের মনাডবাদের অংশত সাদৃশ্য আছে। পরমাণুর মতো মনাড অংশহীন, গবাক্ষহীন ও অবিনশ্বর। কিন্তু অপর কয়েকটি বিষয়ে মনাডের সাথে পরমাণুর পার্থক্য বিদ্যমান। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো-
(১) গুণগত পার্থক্যঃ পরমাণুর মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই, কিন্তু মনাডের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে।
(২) বিভাজ্যগতঃ পরমাণু বিস্তৃতি গুণসম্পন্ন সেহেতু বিভাজ্য। কিন্তু মনাড বিস্তৃতিহীন, সেহেতু অবিভাজ্য কিছু।
(৩) বিন্দুগত পার্থক্যঃ পরমাণু জড়বিন্দু, কিন্তু মনাডতাত্ত্বিক বিন্দু।
(৪) শক্তি প্রক্রিয়ার ধরনঃ পরমাণু নির্জীব ও নিশ্চেষ্ট, কিন্তু মনাড শক্তিস্বরূপ ও সক্রিয়।
(৫) তুলনামূলক পার্থক্যঃ পরমাণুবাদীরা প্রথমে পরমাণুর ধারণা করেছিলেন এবং তারপর পরমাণুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সার্থক নিজ আত্মার সঙ্গে তুলনা করে মনাডের ধারণা করেছিলেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্কের স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনায় পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নামক মতবাদে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেলেও এটাকে একেবারে মূল্যহীন বলা যায় না। কেননা, জগতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও অনেক বিষয়ই নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী চলছে। আর এ চলার পেছনে আগে থেকে কোন কিছু প্রতিষ্ঠিত বিষয় না থেকে পারে না। এ ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকেও যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলেও তার এ মতবাদ খুবই সন্তোষজনক বলে মনে হয়।
Leave a comment