অথবা, দেহ মনের সম্পর্ক বিষয়ক হিসেবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করেই দর্শনের উৎপত্তি। আর এই দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে দেহ ও মন সম্পর্কিত সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কোনো দার্শনিক দেহ ও মনকে একটি দ্রব্য হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো দার্শনিক আলাদা দ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে দেহ ও মন একটি দ্রব্য হোক আর দু’টি দ্রব্যই হোক উভয়ই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে একটি মতবাদ হলো ক্রিয়-প্রতিক্রিয়াবাদ। নিম্নে দেহ ও মনের সম্পর্ক উল্লেখপূর্বক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ ব্যাখ্যা করা হলো-
দেহ ও মনের সম্পর্কঃ দেহ ও মনের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। মানুষ রেগে গেলে তার দৈহিক পরিবর্তনগুলোতে রাগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহে কম্পন দেখা যায় ইত্যাদি। আবার মস্তিষ্কে কোনো গুরুতর আঘাত লাগলে চেতনাশক্তি লোপ পায়। মস্তিষ্কের বৈকল্য অনেক প্রকার মানসিক রাগের কারণ।
দেহ-মনের প্রকৃতি/স্বরূপঃ ফরাসি দার্শনিক ডেকার্টের সময় থেকে দেহ-মনের প্রকৃতি এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক সর্বপ্রথম দেহ-মনের প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রয়াসী হন। তিনি দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি দ্রব্য বলে মনে করেন। তার মতে, দেহের বিস্তার আছে, কিন্তু মনের কোন বিস্তৃতি নেই। মন আধ্যাত্মিক ও প্রজ্ঞাদীপ্ত। মন প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু দেহ জড়ীয়।
মানুষের দেহ ও মন দু’টি আলাদা জিনিস হলেও এ দু’য়ের সমন্বয়েই মানুষ। দেহ থেকে মন আলাদা হয়ে গেলে, দেহ হয়ে পড়ে জড় পদার্থ। মনে যদি কাজ করার ইচ্ছা না থাকে তবে দেহ নিশ্চল হয়ে পড়ে। কারণ মানুষ শুধু জড়দেহের অধিকারী নয়, বরং চেতনা, চিন্তন ও কল্পনার অধিকারী। এক মানুষের মধ্যেই দেহ ও মনের আবাসস্থল। তাই ব্যক্তির দেহ ও মনকে কিছুতেই পৃথক করা সম্ভব নয়।
দেহ-মনের সম্পর্কবিষয়ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদঃ আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক ডেকার্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের সমর্থক। তার মতে, দেহ ও মন দু’টি পৃথক সত্তা। দেহ বিস্তৃতিসম্পন্ন সত্তা, কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। দেহের চেতনা নেই কিন্তু মনের চেতনা আছে। দেই যান্ত্রিক নিয়মের অধীন। মন উদ্দেশ্য বা আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং দেহ ও মনের দ্বৈততা লক্ষ্য করা যায়।
ডেকার্টের মতবাদ আলোচনা করলে একটি প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই এসে পড়ে; সেটা হলো দেহ ও মন যদি পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তাদের উভয়ের মধ্যে যে সম্বন্ধ লক্ষ্য করা যায় তা প্রতিষ্ঠিত হলো কীভাবে? এ প্রসঙ্গে ডেকার্ট বলেন, ইতর প্রাণীর বেলায় এ সমস্যা নেই। ইতর প্রাণীর দেহ-মন বলে কিছু নেই। ইতর প্রাণীর জীবন জড়ের জীবন, যন্ত্রের জীবন। কিন্তু মানুষের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের মধ্যে জড় ও চেতনা, দেহ ও মনের পারস্পরিক সংযোগ ও প্রভাব বিদ্যমান।
তিনি বলেন, জ্ঞানের বেলায় দেহ মনের ওপর কাজ করে আর কাজ করার সময় মন দেহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কোনো কিছু জানতে গেলে ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর সন্নিকর্ষ হয়। এই সন্নিকর্ষ দেহের স্নায়ুতন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মন যখন এই উত্তেজনার কারণ নির্দেশ করে ব্যাখ্যা দেয়, তখনই জ্ঞানের সৃষ্টি হয়।
সমালোচনাঃ দেহ ও মন সম্পর্কিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
(১) পিনিয়েল গ্রন্থি ও দেহ-মনের সম্পর্কের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনিঃ ডেকার্ট বলেন, দেহ ও মনের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়। কিন্তু পিনিয়েল গ্রন্থি দেহেরই অংশ। এর সাথে মনের কী সম্পর্ক? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি ডেকার্ট। পিনিয়েল গ্রন্থি যদি দেহ-মনের মিশ্রণজাত কিছু হয়, তাহলে তা দেহ ও মনকে যুক্ত করতে পারত। কিন্তু এটা না হওয়ার কারণে এ সমস্যার সমাধান হয়নি।
(২) মানুষের ইচ্ছার ক্ষেত্রে কার্যকারণ অকার্যকরঃ দেহ ও মন যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি সত্তা হয় তাহলে দেহ ও মনের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক কীভাবে ঘটতে পারে? কার্য ও কারণ সমজাতীয় না হলে তাদের পক্ষে পরস্পরকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। একটি কঠিন দ্রব্যকে আরেকটি কঠিন দ্রব্য দিয়ে আঘাত করা যেতে পারে, কিন্তু মানুষের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কে কোনো কঠিন বস্তু দিয়ে আঘাত করা যায় না।
(৩) স্ববিরোধী মনে হয়ঃ ডেকার্ট দেহ ও মন সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় প্রথমে বলেন যে, দেহ ও মন দু’টি আলাদা বিষয়। অর্থাৎ তিনি দেহ ও মনকে পরস্পরবিরোধী বলে দেখিয়েছেন। পরে তিনি আবার দেহ ও মনকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল বলেন, এবং উভয়ের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা বলেন। কাজেই দেখা যায় যে, তার এ ব্যাখ্যা স্ববিরোধী।
(৪) স্পিনোজার সমালোচনাঃ ডেকার্টের দেহ ও মনের বর্ণনার একটা উল্লেখযোগ্য ত্রুটি রয়েছে। চেতনসম্পর্কীয় মনের সারধর্ম হচ্ছে এক জিনিস এবং স্থান-দখলকারী দেহের সারধর্ম আরেক জিনিস-এ বক্তব্য থেকে নিঃসৃত হয় না যে দেহ ও মন দু’টি পৃথক সত্তা। একই জিনিসের এ দু’টি গুণ থাকতে পারে। একই জিনিস একই সঙ্গে চিন্তাশীল বস্তু এবং বিস্তৃত বস্তু- উভয়ই হতে পারে। তারই অনুসারে স্পিনোজা ডেকার্টের যুক্তিটির এই ত্রুটি লক্ষ্য করেই পরবর্তীকালে বলেন যে, এ দু’টি পৃথক দ্রব্য নয়, বরং একই দ্রব্যের দু’টি প্রধান ও সমান্তরাল গুণ মাত্র।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মন সম্পর্কিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদের কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হলেও এই মতবাদের যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। কেননা ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ তার পরবর্তী দার্শনিকদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। অর্থাৎ ডেকার্টের পরবর্তী অনেক দার্শনিক তার দেহ ও মন সম্পর্কিত মতবাদ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করলেও ডেকার্টের মতের ওপর ভিত্তি করে তাদের মতবাদ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তবে এটা ঠিক যে, ডেকার্ট তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ দ্বারা দেহ ও মনের সম্পর্কের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, কেননা জড় ও চৈতন্যের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এরা একই পরমাত্মার ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। অথচ ডেকার্ট দেহকে জড়ধর্মী এবং মনকে চেতনধর্মী বলে এদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করেছেন।
Leave a comment