অথবা, দেশ ও কাল কি আত্মগত না বস্তুগত? বিভিন্ন দিক থেকে আলােচনা তুলে ধর।
ভূমিকাঃ কোনাে বস্তুর ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দেওয়ার জন্য আমরা কতগুলাে সাধারণ ধারণা প্রয়ােগ করি এবং এই সাধারণ ধারণাগুলােকেই ক্যাটাগরি বা জ্ঞানের মৌলিক ধারণা বলা হয়ে থাকে। জ্ঞানের মৌলিক ধারণাসমূহের মধ্যে দেশ, কাল, দ্রব্য ও কার্যকারণ সম্পর্ক হলাে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নিম্নে দেশ ও কাল সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-
দেশ ও কাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদঃ মানুষের মনে দেশ ও কালের ধারণার উৎপত্তি সম্পর্কে তিনটি প্রধান মতবাদ আছে। যথা- (ক) স্বজ্ঞাবাদীদের মতবাদ (খ) অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদ এবং (গ) বুদ্ধিবাদীদের বা অভিজ্ঞতাপূর্ব মতবাদ। তা ছাড়া মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দেশ ও কাল সম্পর্ক একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ দিয়েছেন। নিম্নে দেশ ও কালসম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ আলােচনা করা হলাে-
(ক) স্বজ্ঞাবাদীদের মতবাদঃ রিড, মার্টিনিউ, প্রমুখ স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিক মনে করেন, দেশ ও কাল আমরা সােজাসুজি বুঝতে পাই। দেশ ও কাল পরস্পর নিরপেক্ষ দু’টি স্ব-নির্ভর স্বাধীন সত্তা।
(খ) অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদঃ লক, বার্কলি, হিউম, মিল, বেইন, স্পেন্সার, জেমস, ওয়ার্ড প্রমুখ প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিকের মতে, দেশ ও কালের ধারণা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকেই পাওয়া যায়। জন লকের মতে, বিশেষ বিশেষ দেশ ও বিশেষ বিশেষ কালের অভিজ্ঞতা থেকেই দেশ ও কালের ধারণা পাওয়া যায়। বার্কলি, হিউম, মিল, বেইন প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বলেছেন, বিভিন্ন বস্তুর অবস্থান, দূরত্ব ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করার পর দেশ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হয়। আর মনের ও বাইরের ঘটনার পরিবর্তনশীল বিভিন্ন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে কালের ধারণা করা হয়। জেমস, ওয়ার্ড ও তাদের সমর্থকরা মনে করেন, সংবেদনের ব্যাপ্তি থেকেই দেশের ধারণা আসে। সংবেদনের দু’টি দিক হলাে তীব্রতা এবং ব্যাপ্তি। উদ্দীপনা কতটুকু জায়গা নিয়েছে তার ওপর নির্ভর করেই সংবেদনের ব্যাপ্তি। এ ব্যাপ্তি দেশের প্রাথমিক ধারণা দেয়। পরে সংযােজন, বিয়ােজন এবং নির্বাচন পদ্ধতির সাহায্যে দেশের সঠিক ধারণা লাভ করা যায়।
(গ) বুদ্ধিবাদী বা অভিজ্ঞতাপূর্ব মতবাদঃ কান্টের মতে, অভিজ্ঞতাবাদীরা যে বলেছেন বস্তুর অবস্থান, দূরত্ব ইত্যাদি থেকে দেশের ধারণা হয়- তা ঠিক নয়। অপরপক্ষে, তিনি বলেছেন যে, অবস্থান, দূরত্ব ইত্যাদিকে দেশের ধারণা ছাড়া বুঝা যায় না। কাজেই বস্তুর অবস্থান, দূরত্ব প্রভৃতির ওপর দেশের ধারণা নির্ভর করে না, বরং দেশের ধারণার ওপরই এগুলাে নির্ভর করে। তেমনি করে মনের বা বাইরের পরিবর্তনশীল অবস্থা থেকে কালের ধারণা লাভ করা যায় না, বরং কালের ধারণা থেকে এসব পরিবর্তনের কথা জানা যায়। তাই তিনি বলেছেন, প্রত্যক্ষ বা অভিজ্ঞতার ওপর দেশ ও কালের ধারণা নির্ভর করে না। দেশ ও কাল অভিজ্ঞতাপূর্ব সমস্ত অভিজ্ঞতাই দেশ ও কালের ওপর নির্ভর করে।
দেশ ও কাল সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদঃ নিউটন দেশ ও কালসম্পর্কিত সমস্যাকে বৈজ্ঞানিক মর্যাদা দেন। তার মতে, দেশ ও কাল হলাে দুটি স্বতন্ত্র ও বিষয়গত সত্তা। দেশে বস্তু অবস্থান করে এবং কালে ঘটনা ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে নতুন নতুন গবেষণা ও পুরনাে মতবাদের অনেক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে নতুন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। মিকোস্কি আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞানীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। মিকোস্কি প্রথমে দেশ ও কালের আপেক্ষিক তত্ত্বের কথায় বলেন যে, দেশ ছাড়া কালের এবং কাল ছাড়া দেশের অস্তিত্ব নেই। আইনস্টাইন মিকোস্কির দেশ ও কালের আপেক্ষিক তত্ত্বের উন্নতি সাধন করে বলেন যে, দেশ ও কাল বস্তুগত বা বিষয়গত সত্তা নয়, বরং এ হলাে আপেক্ষিক ও আত্মনির্ভর সত্তা। এই দেশ-কাল দ্রষ্টা-জ্ঞাতা ছাড়া অর্থহীন। বিজ্ঞান এখন সাধারণত দেশ ও কালের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং চার মাত্রাবিশিষ্ট জগতের ধারণাতে বিশ্বাস করে, যেখানে কাল হলাে চতুর্থ মাত্রা। দর্শনের ক্ষেত্রে এই মতবাদের প্রধান গুরুত্ব এই যে, বহুদিন ধরে দার্শনিকরা জড়বস্তুকে যে জগতের আদিম উপাদান বলে মনে করতেন, তার মূলে এ মতবাদ কুঠারাঘাত হেনে বলিষ্ঠভাবে ঘােষণা করে যে জড় বিশ্বের এক স্বাধীন মৌলিক নীতি নয়।
দেশ-কাল বিষয়গত না আত্মগতঃ দেশ-কাল বিষয়গত না আত্মগত এ জটিল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারাে কারাে মতে, দেশ ও কালের বিষয়গত সত্তা আছে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত নিচে আলােচনা করা হলাে-
ডেকার্টঃ দার্শনিক ডেকার্টের মতে, দেশ এবং বিস্তৃতি এক। দেশ বা বিস্তৃতি আসল দ্রব্য নয়। দেশ বা বিস্তৃতি হলাে জড় দ্রব্যের গুণ। এ বিস্তৃতিই জড়ের ধর্ম। দেশের বিষয়গত সত্তা আছে।
স্পিনােজাঃ দার্শনিক স্পিনােজার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য এবং সত্য। এ দ্রব্যের অনন্ত গুণ আছে। বিস্তৃতি বা দেশ এ অনন্ত গুণের অন্যতম গুণ। কাজেই দেশের বিষয়গত সত্তা আছে।
লাইবনিজঃ লাইবনিজের মতে, দেশের কোনাে বিষয়গত সত্তা নেই। তার মতে, ভাবাত্মক বা চেতন পরমাণুই হলাে পরম তত্ত্ব। এ চেতন পরমাণু জড় নয়। কাজেই দেশ এর ধর্ম হতে পারে না। দেশের আসল সত্তা নেই। কাল জ্ঞাতা মনের ধারণা বিশেষ।
লক, বার্কলি, হিউমঃ লক, বার্কলি, হিউম প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক মনে করেন, দেশ-কাল সামান্য ধারণা। অভিজ্ঞতালব্ধ বিশেষ বিশেষ দেশ-কালের থেকেই আমরা এ সামান্য ধারণা লাভ করে থাকি।
কান্টঃ কান্টের মতে, দেশ ও কাল মননিরপেক্ষ বস্তুগত সত্তা নয়। দেশ ও কাল আবার অভিজ্ঞতাপূর্ব। দেশ ও কাল মনের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, এ সম্পর্কে তিন ধরনের মতবাদ প্রাশ্চাত্য দর্শনে পরিলক্ষিত হয়; যেমন, বস্তুগত মতবাদ, আত্মগত বা ভাববাদী মতবাদ এবং ধারণাগত মতবাদ। বস্তুগত মতবাদের চিন্তাবিদদের মধ্যে ডেকার্ট, স্পিনােজা, মার্টিনিউ, ম্যাককোস্ট, নিউটন, আলেকজান্ডার, বার্গসাে প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। এসব চিন্তাবিদের মতবাদ সাধারণত দেশ ও কাল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার সাথে অনেকাংশে খাপ খায়। আত্মগত মতবাদের চিন্তাবিদদের মধ্যে প্লেটো, লাইবনিজ, বার্কলি, হিউম, কান্ট প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। ধারণাগত মতবাদের চিন্তাবিদদের মধ্যে লক, মিল, বেন প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
Leave a comment