রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত রচনার বুড়াে কর্তা ছিলেন দেশবাসীর অভিভাবকস্বরূপ। তিনি মারা যাওয়ার সময় দেশবাসী তাকে জানাল যে, তিনি চলে গেলে তাদের অবস্থা ভীষণ সঙ্গিন হয়ে উঠবে। এ কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ দুঃখ পেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পরও দেশসুদ্ধ লােক কীভাবে নিশ্চিন্ত থাকবেতাই নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত হলেন। কিন্তু মৃত্যুকে তাে কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই সমাধান হিসেবে ভগবান জানালেন যে, চিন্তার কিছু নেই, মৃত্যুর পর বুড়াে কর্তা ভূত হয়ে দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে থাকবেন চিরকাল। কারণ, মানুষের মৃত্যু হলেও ভূতের যে মরণ নেই। এভাবেই বুড়াে কর্তার মৃত্যুর পর তাঁর ভূতের অভিভাবকত্বে থাকার নিশ্চয়তা পেয়ে দেশের লােক ভারি নিশ্চিন্ত হল। আসলে যে মানুষ মনের দিক থেকে দুর্বল, তারা কোনােনা-কোনাে একটা অবলম্বন চায়। অভিভাবকহীন জীবন তাদেরকে অস্থির করে তােলে। অথচ তারা শান্তিতে বাস করতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ শাসনে ভারতবাসীর মেরুদণ্ডহীন অবস্থাকে স্পষ্ট করতে চেয়েছেন তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত রচনায় আমরা দেখি যে, বুড়াে কর্তা মারা গেলেও দেবতার দয়ায় তার ভূত দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসে রইলেন। বেশিরভাগ দেশবাসী এতে নিশ্চিন্ত নিরুদবিগ্ন হলেও কয়েকজন মানুষ এ ব্যাপারটা ভালাে চোখে দেখলেন না। ফলে তাঁরা ভূতের কানমলা খেলেন এবং নিরস্ত হলেন। অতঃপর দেশসুদ্ধ লােক ভূতে-পাওয়া অবস্থায় চোখ বুজে জীবন কাটাতে লাগলেন। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরাও দেশবাসীর এই আচরণকে সমর্থন করলেন।

দেশের তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরা বললেন যে, চোখ বুজে চলাই হল পৃথিবীর অতি প্রাচীন চলন—এই চলাকেই বলে নিয়তির নিয়মে চলা। বিশ্বসৃষ্টির প্রথম যুগে অন্ধ এককোশী জীবেরা তেমনভাবেই চলত, ঘাস থেকে শুরু করে সমস্ত প্রকারের উন্নত বৃক্ষের মধ্যে তেমনই চলার ইঙ্গিত স্পষ্ট। এই কথাগুলির রূপকার্থ হল এই যে, ধর্মতন্ত্রকে অনুসরণ করে অন্ধের মতাে এগিয়ে চলাই মানুষের আদিম চলন। নিয়তির কাছে, ভাগ্যের কাছে নিজের কর্তব্যবুদ্ধি ও বিবেকবুদ্ধিকে সঁপে দেওয়াই হল ধর্মতন্ত্র নির্দেশিত পথে প্রশ্নাতীত অন্ধ আনুগত্য নিয়ে চলা। এটিই হল অদৃষ্টের চালে চলা এবং চোখ বুজে চলা’, যার কথা তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত’রচনায় একটি ভুতুড়ে জেলখানার কথা বলা হয়েছে। ভূতশাসিত সেই জেলখানার দারােগা হল ভূতের নায়েব। এই ভুতুড়ে জেলখানার পাঁচিল খালি চোখে দেখা যায় না। তাই সেই জেলে বন্দি দেশবাসীরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না যে, কীভাবে সে পাঁচিল ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

রূপকের আড়ালে অন্তর্নিহিত যে অর্থটি এখানে প্রকাশ পাচ্ছে তা হল, ধর্মতন্ত্রের ঘেরাটোপই হল ধর্মবন্দি অর্থাৎ ধর্মভীরু মানুষদের জেল-প্রাচীর। পুরােহিত বা যাজক শ্রেণি হল সে জেলখানার পাহারাদার। ধর্মতন্ত্রের বাঁধনটা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ খালি চোখে দেখতে পায় না বলেই তাকে অস্বীকার করে মুক্ত হবার উপায়টাও তাদের অজানা থাকে।

অন্যান্য জেলখানার মতাে ভূত-নিয়ন্ত্রিত কারাগারেও অপরাধীদের ঘানি ঘােরাতে হয়। তবে, অবিরাম ঘুরিয়েও সেখানকার ঘানি থেকে এক ছটাক তেলও বের হয় না। বের হয় কেবল ঘানি-ঘােরানাে মানুষের তেজ ও শক্তি।

ভুতুড়ে জেলখানার কয়েদিদের ঘানি ঘােরানাের রূপকের মধ্য দিয়ে লেখক ধর্মতন্ত্র-নির্দেশিত শ্রমের কথাই বলতে চেয়েছেন। ধর্মতন্ত্র-নির্দেশিত শ্রম অর্থাৎ ঈশ্বর-আরাধনা এবং ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের তেমন কোনাে আর্থিক মূল্য নেই যা সমাজের উন্নতিতে সাহায্য করবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্তার ভূত ছােটোগল্পে আমরা দেখি যে ভূতশাসিত দেশের একদল অর্বাচীন ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করে যে, “ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চলবে।” এই অলক্ষুনে প্রশ্ন শুনেই ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এবং মাসতুতাে পিসতুতাের দল কানে আঙুল দেয় এবং এসব কথাকে তারা সর্বনাশ বলে চিহ্নিত করে। তারা জানায় যে, তেমন অলক্ষুনে কথা তারা কখনও শােনেনি। ভূতের শাসন না থাকলে সব রকম জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম এবং আদিমতম চিরন্তন ঘুমের কী হবে—সেই পালটা প্রশ্নই তারা ছুঁড়ে দেয়।

আসলে, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এবং মাসতুতাে পিসতুতােরা অর্থাৎ ধর্মতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা প্রাচীন রীতিনীতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তােলার মধ্যেই সমূহ বিপদের ইশারা খুঁজে পায়। তারা সেই প্রশ্নবাণকে ঐতিহ্যের ওপর আঘাত বলে চিহ্নিত করে নিজেদের সেই প্রশ্ন শােনা থেকে বিরত রাখতে চায়। এতেই তাদের মানসিক শান্তি।

রবীন্দ্রনাথ চিরকালই স্থবিরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সনাতনপন্থীরা ধর্মের ধ্বজা নিয়ে জাঁকিয়ে বসে বলেই তাে সমাজের অগ্রগতি থেমে যায়। তারা কোনাে যুক্তিসংগত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না।