“ফসিল” শ্রেণি সংঘাতের চিত্র নানা শ্রেণির আশ্চর্য বর্ণনায় লিপিবদ্ধ- আলোচনা করো।

সাহিত্য জীবন সম্ভব— জীবনের রসায়নাগার। সাহিত্যিকের জীবন অভিজ্ঞতা আর সৃষ্টির ক্ষমতাতেই সাহিত্যের সৃজন। সুবোধ ঘোষ যাযাবর জীবনের অভিজ্ঞতায় আদিবাসীদের অচিনলোক গড়লেন অঞ্জনগড়ে। সাহসী কল্পনায়, রূঢ় প্রত্যক্ষ বর্ণনায় সংকেতগর্ভ বর্ণ বিন্যাসে এক আশ্চার্য প্রতিবেশের জন্ম হয়েছে গল্পে। সেখানে আদিবাসী প্রস্তরযুগ, রাজতন্ত্রের মধ্যযুগ আর বণিকের আধুনিকযুগ বেমানানভাবে সহাবস্থান করে। “Extreme Reality’র জন্য সেখানে ডারউইনের “Survival of the fittest” তত্ত্ব জয়ী হয়।

আয়তনের চেয়ে অহমিকায়, আকারের চেয়ে প্রকারেও বহরে ভারি রাজতন্ত্রের কথা প্রথমে। নেটিভ স্টেট অঞ্জনগড়ের রাজার অত্যাচারে সীমাহীন। অত্যাচারের চোটে অর্ধেক প্রজা দেশছাড়া। প্রজার রক্ত জল করা ভুটাজনার যায় রাজার পোলোর ঘড়ার পেটে। কুর্ম্মিরা বিদ্রোহ করে মাঝে মাঝে—ফৌজদাররা লাঠি গুলিতে দমিয়ে দেয়। এমনকি “চিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা—সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয় তার সাথে পোলার দল, ফৌজদার হাজার পদ বজায় রাখার আর্থিক শক্তিও ছিল না স্টেটের, তাই সাবেক কালের রাজসিন্দুকে হাত পড়েছিল বারবার।

ল এজেন্ট খোলনালচে বদলাতে শুরু করে। এরপর আসে অভ্র খনির হাত ধরে বণিকশ্রেণি—গিবসন তাদের মাথা। তারা পর্দার আড়ালে থেকে শক্তিকে নিজেদের হাতে আনতে চাইল। দুলাল মাহাতোকে হাতিয়ার করে প্রজাদের রাজবিদ্রোহী করার পথে নামল। আপাতদৃষ্টিতে একে প্রজাকল্যাণ মনে হয়, কিন্তু তাদের এ ছিল কূটকৌশল—কাজে এক, নজর অন্যদিকে। মুখার্জী প্রজাদের রাজার বিরুদ্ধে ক্ষেপাতে নিষেধ করলে গিবসন বলে—“আমরা মানি মেকার নই, আমাদের একটা মিশনও আছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষে নিয়ে আমরা চিরকাল লড়ে এসেছি।” অপমান করে মুখার্জীকে তাড়ালে সমর্থক ম্যাককেনা বলে—“শুনেছ তো ওর ইরিগেশন স্কীম সময় থাকতে ভন্ডুল করে দিতে হবে, নইলে সাংঘাতিক লেবারের অভাবে পড়তে হবে। “বাড়তি কারবার সচল রাখাই এদের ‘মিশন’।

মাঝে আদিবাসীরা। তারা চিরকাল শোষিত হয়—মূর্খতার জন্য, মনুষ্যত্বের উদ্বোধনের অভাবে। আগে রাজা শোষণ করত, এখন করে খানি মালিক। দুলাল মাহাতোকে সামান্য ‘কেরোসিন ও কয়লা’ আর ধাওড়ায় থাকার স্বপ্ন দেখায়। রাজার বিরুদ্ধে কুর্ম্মিদের ক্ষেপায়। দিলীপ দরবারে চিঠি যায়, প্রজারা বেগার খাটতে রাজি হয় না। এবার তৈরি হয় শ্রেণি সংঘাতের জটিল রসায়ন। গল্প Climax-এ পৌঁছায়। প্রথমে খনি দুর্ঘটনায় নব্বইজন কুলিন প্রাণ যায়। এ ধরবে জয়ের মত্ততা আনে রাজার—“এইবার দুশমন মুঠোর মধ্যে, নির্দয়ের মতো পিষে ফেলতে হবে এইবার। অন্যদিকে রাজার ফৌজদারের মুন্সেরী বুলেটের মরে বাইশজন আদিবাসী। বিমূঢ় রাজা—“তাঁর চোখের সামনে পলিটিক্যাল এজেন্টের হুঁসিয়ারী চিঠিটা যেন চকচকে সূচীমুখ বর্শার ফলার মতো ভেসে বেড়াতে লাগল।” গিবসনও তো বেকায়দায় মহারাজা সব জেনে যাবে, মাহাতো ক্ষেপে যাবে। “কালকে সকালেই শহরের কাগজগুলো’ খবর পেয়ে যাবে আর পাতা ভরে স্ক্যান্ডাল ছড়াবে দিনের পর দিন”।

স্বার্থই স্বার্থত্যাগের কারণ। শত্রু যাদের এক মিত্র তারা হবেই। যুযুথান দুই পক্ষ তাই হাত মেলায়। ইতিহাসে যেমন হিটলার স্ট্যালিন। শ্রেণি সংঘাতের বলয় বদলে যায়। এবার দাবার চাল পাল্টেযায়। রাজা আর খনি-বণিকের চক্রান্তে কুর্ম্মিরা বলি হয়, ফসিলে পরিণত হবার জন্য নিক্ষিপ্ত হয় খনিতে। “যেমন গল্প-কথা, তেমন গল্প পরিবেশ শ্বাসরোধী সংঘাত ও সংঘর্ষে জমাট—“লিখেছেন ভূদেব চৌধুরী। শ্রীকুমারবাবুও সেই পরিবেশ আর সংঘাত কৌশল সম্বন্ধে বলেন—“একদিকে নামমাত্র রাজার অভ্রভেদী অহমিকাবোধ, অন্যদিকে ইউরোপীয় বণিকসংঘের কুট ষড়যন্ত্রজাল ও ইহাদের অঙ্গুলিসংকেতে মূঢ় প্রজাসাধারণের বিদ্রোহোম্মুখতা—এই সমস্ত বিপরীত তরঙ্গের মধ্যে মুখার্জীর আদর্শবাদ ও উদারনীতির বানচাল” এবং সব মিলিয়ে “অঞ্জনগড়ের নেটিভ স্টেটের শাসন সমস্যার জটিলতা কয়েকটি অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত ও সুনির্বাচিত তথ্যের সাহায্যে স্ফটিক স্বচ্ছ হইয়াছে।” (বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা)

এ মার্কস কথিত শ্রেণি-সংঘাত নয়, নইলে শ্রমিক আদিবাসীর এ হেন দুর্দশা ঘটত না। লেখকের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হত অন্তত, Sub-human দের মুখতা, আত্মহননের প্রবণতাকে নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব জীবন হোত না। আসলে এ শিল্পীর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমকালে থেকে সামনের কালকে দেখার দুরদর্শিতা। তাই শ্রেণি সংঘাতের ‘মতবাদ নয়, এ সুবোধ ঘোষের একান্ত আবিষ্কার। অঞ্জনগড়ের অচিনলোক তাই আদিবাসী জীবনের প্রস্থানলোক। রূঢ় বাস্তবলোক।