যুদ্ধোত্তর আধুনিক সভ্যতা এবং সমগ্র বিশ্বের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন আধুনিক মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে এক গূঢ় জটিলতা। উত্তরাধুনিক পর্বে তাই সাহিত্য-শিল্পে দেখা দিয়েছে সর্ব বিষয়ে আস্থাহীন, বিশ্বশৃঙ্খলায় অবিশ্বাসী, সর্বগ্রাসী এক বিশ্বাসহীনতার দর্শন। প্রেম, প্রীতি, ঈশ্বর, সৌন্দর্যচেতনা, মানবতা ইত্যাদি মহৎ ব্যাপারগুলো এই আধুনিক মানুষ প্রহসন বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কেননা ঈর্ষা-হিংসা-যুদ্ধ ক্ষুব্ধ এই পৃথিবীতে ওইসব প্রেম, সৌন্দর্য, মানবতার বাণী মূল্যহীন। আধুনিক কবি তাই চতুর্দিকে দেখেন পোড়ো জমি, খড় পোড়া মানুষ, ভাঙা জাহাজ আর নষ্ট শশার প্রতিচ্ছবি। আধুনিক কবিতাতেও তাই বারবার উঠে আসে এক ধরনের শূন্যতাবোধ, গাঢ় নৈরাশ্য, চোরাবালির টান ও মৃত্যু অভীপ্সা।
এই আধুনিক জটিল সময়ের দুর্বোধ্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক যুগজীবন তীব্রভাবে উপস্থিত তাঁর কবিতায় এবং সংবেদনশীল মানবতাসন্ধানী কবিমনের অতৃপ্তি ও যন্ত্রণা তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত। অনেকে বলেন, এই বিমূঢ় যুগের জটিলতম বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ। কেউ বলেন তিনি নির্জনতাবিলাসী। কিন্তু এই কোনো অভিধাই বোধহয় জীবনানন্দ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সত্য নয়।
কেননা আধুনিক বিক্ষত যুগের কবি হলেও এবং তীব্রভাবে কালসচেতন হলেও জীবনানন্দের কবিতায় আদ্যোপাত্ত উপস্থিত থাকে সৌন্দর্যের প্রতি প্রেমের প্রতি, মানবতার শুদ্ধতম রূপটির প্রতি এক গভীর আস্থা। ‘বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের ‘সুচেতনা’ কবিতাতেও তা উপস্থিত।
সমগ্র কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার শেষ দুটি পঙক্তি আপাতভাবে কিছুটা বিভ্রান্তিকর ও দুর্বোধ্য মনে হলেও কবিচেতনার মৌলধর্মটির কথা স্মরণে রাখলে উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব।
‘সুচেতনা’ কবিতায় সুচেতনা নামে কোনো নারী অথবা মানুষের সুচেতনা বা শুভচেতনার প্রতি কবির আন্তরিক হৃদয়াকর্ষণ ব্যঞ্ছিত। এই সুচেতনার প্রতি হৃদয়াকর্ষণের বিপরীতে সমগ্র কবিতা জুড়ে রয়েছে বর্তমান সভ্যতার এক প্রতিকূল প্রতিচ্ছবি। সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়ে মানুষের কল্যাণপ্রয়াসে নিয়োজিত হয়ে এই মানবসভ্যতা এমন এক ভ্রষ্ট পথে এসে উপনীত হয়েছে, যেখানে মানুষ আবিষ্কার করে বন্ধু-পরিজনের রক্তে রক্তাক্ত তার নিজের হাত। হিংসা, ঈর্ষা, ক্ষমতা কিংবা দাঙ্গা ও যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত এই পৃথিবীতে আজ কবি আবিষ্কার করেন দুরারোগ্য অসুখের বীজ ক্রমশ মহীরুহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সভ্যতা তার বাহ্য বিকাশের পথে অগ্রসরমান। সভ্যতার এই বিকাশকে এই ক্রমাগ্রসরতাকে অস্বীকার না করেও কবি এই মানবকল্যাণ বিচ্যুত সভ্যতার বিজয়ধ্বজকে শেষ সত্য বলে স্বীকার করতে পারেন না। বরং সুচেতনাকেই তিনি সন্ধান করেন।
যদিও কবি বিশ্বাস করেন মানব-সভ্যতায় সেই সুচেতনার অর্জন সহজ নয়। সভ্যতা ও ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে বহু ধর্মাত্মা, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, সমাজনায়ক মানবতার সাধনায় প্রয়াসী হয়েছেন, এমনকি আত্মোৎসর্গ করেছেন। বুদ্ধ, যিশু, কনফুশিয়াস, চৈতন্য কিংবা জিওরদানো ব্রুনো, গ্যালিলেও গ্যালিলি মানবকল্যাণের পথে সভ্যতাকে অগ্রসর করে দিতে চেয়েছেন। আজকের যুদ্ধ ক্লান্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সেই সব প্রয়াস যেন ব্যর্থ হয়ে গেছে। ঈর্ষা, হিংসা, অমানবিকতার ব্যাধিবীজই যেন সভ্যতায় জয়ী হয়েছে। ফলে সেই মানবিক বিশুদ্ধ শুভ্র আলো আজও আয়ত্তাতীত। কবি মনে করেন, আরও বহু শতাব্দী বহু মনীষীর ক্রমাগত প্রয়াসে সেই মানবতার প্রভাত হয়ত প্রকাশিত হবে পৃথিবীতে—”সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যৎমুখী ইতিহাসের বোধ নিয়ে, কালগতির এক বৃহৎ চেতনায় সঞ্জীবিত হয়ে জীবনানন্দ যেন খণ্ড ইতিহাসের বা সমসাময়িক কালের সত্যকে অতিক্রম করে এক দার্শনিক সত্য উপলব্ধি করেন। এই অখণ্ড কালচেতনায় সাফল্য-ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। মানবসভ্যতা নানা উত্থান-পতন সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে ক্রমাগত অগ্রসরমান। মানুষের ক্রমাগত প্রয়াস সেই কালচক্রকে গতি দান করে মাত্র। সেই কালের খণ্ডাংশে কোনো এক বিশেষ সময়ে হয়ত মনে হয় সব ব্যর্থ, বা মনে হয় সভ্যতা এখন চূড়ান্ত সফল। কিন্তু এ সেই খণ্ডদৃষ্টি। মানুষ যা পেরেছে, যা অর্জন করতে পারেনি, কিংবা যে সাফল্য মানুষ কোনোদিনই পাবে না, অখণ্ড কালের ইতিহাসে সেই খণ্ড পরিমাপের কোনো মূল্য নেই। মহাশূন্যে পার্থিব রাত্রি প্রভাতের পরিমাপ অবান্তর। সেখানে যেন সমস্তই ‘শাশ্বত রাত্রি’ কিংবা ‘অনন্ত সূর্যোদয়’। তেমনি মহাকালের প্রেক্ষিতে সভ্যতার ইতিহাসপথে মানুষের অগ্রগতি ও মানবতা সন্ধানের অবিশ্রাম প্রয়াস, বা তার ব্যর্থতার খতিয়ান, বা অপ্রাপ্তির অতৃপ্তি—সবই সেই অখণ্ড গতিসূত্রে প্রথিত। মানুষের সমস্ত প্রয়াসই আসলে দার্শনিক দৃষ্টিতে চিরন্তন রাত্রি থেকে অনন্ত সূর্যোদয়ের পথে অভিযাত্রা।
Leave a comment