‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র চার নায়িকা দ্রৌপদী, শকুন্তলা, ভানুমতী এবং দুঃশলা প্রোষিতভর্তৃকা। ভানুমতী ও শকুন্তলা স্বামীর অমঙ্গল আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিতা। দ্রৌপদীর মতো শকুন্তলারও প্রোষিতভর্তৃকা এবং বহু পত্নীক স্বামীর পত্নী। কিন্তু শকুন্তলা সরলা ঋষি বালিকা ; ব্যঙ্গবাণে কারোর মর্মভেদ করা তপোবন পালিতার পক্ষে স্বাভাবিক নয়। কিন্তু যন্ত্রণা তো উভয় নারীরই এক। তাই দ্রৌপদী যখন ব্যঙ্গের আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে শকুম্ভলা ভোগ্যের ওপর দোষারোপ করেছে। প্রেমের কুটিলগতির কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলেছেন নীরবে।
শকুম্ভলা হল ঋষি কন্বের পালিত কন্যা। সে হল অপ্সরা মেনকার কন্যা। জন্ম মুহূর্তে তার মা তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। তাই সে কন্বের আশ্রয়ে বড়ো হয়। রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার গান্ধবর্মতে বিবাহ হয়। কিন্তু মধুসূদন শুকুন্তলার চরিত্রকে একটু পরিবর্তন করেছেন। শকুন্তলা স্বামী দুষ্মন্তের ফিরে আসার জন্য উৎকণ্ঠা হয়ে পত্র লিখেছে।
মূল কাহিনিটি মধুসূদন সংগ্রহ করেছেন সংস্কৃত নাট্যকার কালিদাসের লেখা ‘অভিজ্ঞান শকুম্ভলম’ নাটক থেকে। এই মূল কাহিনিতে কালিদাস শকুন্তলাকে এই ধরনের পত্র লেখার সুযোগ দেননি। দুষ্মন্তের উপস্থিতিতে পদ্ম পাতায় শকুন্তলা পত্র লিখেছে। এই পত্রটি পরিবর্তন করে মধুকবি মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
গান্ধর্ব মতে শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের বিবাহ হয়। যাওয়ার সময় তিনি শকুন্তলাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে শীঘ্রই তাকে সমাদরে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে অন্তঃপুরে স্থান দেবেন। কিন্তু দুষ্মন্ত আর এলেন না। শকুন্তলাকে তিনি বিস্মৃতি হলেন। কোনো খবরও নিলেন না তার। অসহায়া শকুন্তলা আসন্ন মাতৃত্বের সম্ভবনা হৃদয়ে নিয়ে দুষ্মন্তের প্রতীক্ষা করত। বাতাসের শব্দ, ধুলোরাশি ওড়ার দৃশ্য তাকে আশান্বিত করে তুলত—
“ওই শোন কলাহল। পুরবাসী যত
আসিছে লইতে মোরে নাথের আদেশে’।
কিন্তু এ আশা আশাই থেকে যায়। সে ছুটে যায় নিকুঞ্জবনে সেখানে কোকিলের গান, কপোত কৃজন, অলি গুঞ্জন, কিছুরই অভাব নেই কিন্তু চোখ তো দেখতে পায় না সেই কাঙ্ক্ষিত পদযুগল। কোনদিকে তার কোনো চিহ্নই নেই। নয়ন তার ভেসে যায়।
বিরোহিণী শকুন্তলার সম্বল তো স্মৃতি আর চোখের জল। তাই মনে পড়ে যায় যখন ভ্রমর এসে তার অধরে দংশন করতে গিয়েছিল তখনই তো আবির্ভূত হয়েছিল পুর কুল বিধি দুষ্মন্ত। তপোবনের দুষ্মন্তের স্মৃতি-বিজাড়িত ঘটনাগুলি মনে পড়ে যায় শকুন্তলার। আজ শকুন্তলার পরিত্রাণে এগিয়ে আসবেন না কেউ। বিরহলীনা শকুন্তলা হৃদয় যন্ত্রণা গোপন করতে চান। নতুবা তাঁর সখীরা রাজাকে নিন্দা করলে পতিগত প্রাণার তা সহ্য হবে না। গৌতমী তপস্যারতা, তাই তিনি এখনো এ সংবাদ জানেন না।
বিষাদময়ী বিরহিণী শকুন্তলা সংজ্ঞা হারান ক্ষণে ক্ষণে। চৈতন্য লাভের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখে ভেসে ওঠে দুষ্মন্তের মূর্তি। দুহাত বাড়িয়ে ছুটে যান তিনি কিন্তু সেই ভুল ভেঙে যায় চোখের জলে। ক্রন্দনরতা শকুন্তলা তাই বলে—
“কি পাপে সহি হেন বিড়ম্বনা!
কি পাপে পীড়েন বিধি, শুধিব তা কারে ?”
নিদ্রার আবেশে স্বপ্ন শকুন্তলার হৃদয়ে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যের লীলা। মধুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন তার অবচেতন মনে। কিন্তু ‘নিশার স্বপন সুখে সুখী যে কি সুখ তার, জাগে সে কাঁদিতে।
শকুন্তলা তার এই দুর্ভাগ্যের জন্য কেবল বিধাতাকে দায়ী করে—
“হে বিধাতা, এই কি রে ছিল তোর মনে?
এই ফিরে ফলে ফল প্রেমতরু শাখে ?”
তপোবনের কুটির বাসিনী বালিকাকে পৃথিবীর রাজরাজেশ্বর যে চরণে স্থান দিয়েছেন তাই তো তার কাছে অনেক। বালিকা তার হৃদয়েশ্বরী হওয়ার আশাই বা করবে কেন? বনবাসিনী বল্কল বসনা বালিকা রাজাধিরাজের সহধর্মিণী হয়েছে। মায়াদেবী স্বপ্নে স্বামীর ঐশ্বর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও তার মনে ঐশ্বর্যের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
‘কি কাজ, প্রভু, রাজ্যসুখ-ভোগে ?
আকাশে করেন কেলি লয়ে কলাধারে
রোহিণী, কুমুদী তাঁরে পূজে মর্ততলে
কিঙ্করী করিয়া মোরে রাখ রাজপদে।”
তবুও স্বামীর প্রতি ভালোবাসাই তার মনে আশার শেষ কিরণটিকে মুছে দিতে দেয় না। আশাহত নারীর এই দুরাশা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাসে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে। শকুন্তলার পত্রটি করুণ আর্তিতে পূর্ণ। কাননে কুসুমকলি ফুটেছিল। রাজা দুষ্মন্ত কি পদদলিত করার জন্যই তাকে বৃত্তচ্যুত করলেন ? শকুন্তলার পত্রে হৃদয়ের এই প্রশ্নই ভাষা পেয়েছে অশ্রুজলে।
শকুন্তলা পত্রিকার অন্য একটি বৈশিষ্ট্য আছে যা আর কোনো পত্রিকায় আমরা দেখতে পাই না। রাজার প্রতি তার কোনো ক্ষোভ বা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ নেই।
শকুন্তলার প্রেম দ্বন্দ্ব সংসয় বিজড়িত। কুটীর বাসিনী হবে রাজা রাজেশ্বরী-এত বড়ো সৌভাগ্য কি তার ভাগ্যে আছে ? যদি তার প্রিয়তমের বিস্মৃতিই চির স্থায়ী হয়, অভাগিনীকে তাহলে দুঃখ যন্ত্রণা বুকে করেই কাটাতে হবে চিরকাল। সংশয়াছন্ন এই প্রেম, কিন্তু এর মধ্যেই আছে ভবিষ্যৎ প্রেম প্রতিষ্ঠার এক স্বপ্নময় চিত্র। স্বপ্নে সে দেখে প্রিয়তমের ঐশ্বর্য। কিন্তু সে তা রাজৈশ্বর্য চায় না। চায় শুধু স্বামীর চরণ দুটি।
“কিন্তু নাহি লোভে দাসী বিভব! সেবিবে
দাসী ভাবে পা দুখানি এই লোভমনে
এই চির আশা নাথ, এপোড়া হৃদয়ে।”
জন্মাবধি দুর্ভাগ্য শকুন্তলার সঙ্গী। পিতা মাতা তাকে ত্যাগ করেছেন। তার স্বামীও কি তাকে পরিত্যাগ করবে এই নব যৌবনে।
শকুন্তলার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জ্বালা নেই তার চিঠিতে। শুধু আছে অভিমান মিশ্রিত বেদনা। সেভাবে—
“শুখাইলে ফুল, কবে কে আদরে তারে!”
বনের পাখিকে বধ করেছেন রাজা। শকুন্তলার আনন্দ-শান্তি-সুখ আজ বিনষ্ট। তবুও শকুন্তলা রাজাকে কোনো দোষ দেয় না। নিজের দুভার্গের কথা স্মরণ করে কেবল চোখের জল ফেলে। আর ভাবে, সে তো রাজৈশ্বর্য চায় না। শুধু স্বামীকে সে ফিরে পেতে চায়। দুর্ভাগ্যের অশ্রু নীরে নিমজ্জিতা শকুন্তলাকে এই আশাই বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রেমের গভীরতা শকুন্তলা চরিত্রটিকে উজ্জ্বল ক’রে তুলেছে। মহাকবি কালিদাসের নায়িকা মধুকবির কলমে এক অন্য মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এই ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’।
Leave a comment