বর্তমানে সংবাদপত্র টেলিভিশন ও বিভিন্ন মহলে দুর্যোগ (Hazard) ও বিপর্যয় (Disaster) সম্বন্ধ প্রায়শই শােনা যায়। এ সম্পর্কে পরিবেশবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, ভূতত্ত্ববিদ এবং ভৌগােলিকগণের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা আছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দুর্যোগকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতেই বেশি আগ্রহী আবার এই বিষয়ে ভূতত্ত্ববিদ ও ভৌগােলিকদের মধ্যে সামান্য মতভেদ রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদরা দুর্যোগের আলােচনায় প্রাকৃতিক ভূগাঠনিক প্রভাব (Natural Geological Factors) আর ভৌগােলিকরা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ (Anthropogenic Factors ) এর উপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন।

Hazard শব্দটি প্রাচীন ফরাসি শব্দ এবং Az-Zahr নামক আরবি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হল Chance or Luck | প্রাকৃতিক বা মানবিক কারণে সংঘটিত যে সকল ঘটনার দ্বারা মানবজীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের স্বাভাবিক অবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে বা হয়ে থাকে তাকে দুর্যোগ (Hazard) বলে। UN0র প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী দুর্যোগ বলতে বােঝায় প্রাকৃতিক এবং মানুষের কার্যাবলির মাধ্যমে সৃষ্ট যে সকল ঘটনাবলি জীবন ও সম্পত্তির হানি ঘটায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি অথবা পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন ঘটায়, তাদের দুর্যোগ বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্যোগের সৃষ্টি হয় প্রকৃতিগতভাবে। দুর্যোগে তৎক্ষণাৎ জীবনহানি ও সম্পদহানির সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু দুর্যোগ হলেই যে সম্পদহানি বা প্রাণহানি হবে তার কোনাে মানে নেই। যেমন-সমুদ্রের মধ্যে যদি প্রবল ঘূর্ণবাত (টাইফুন, হ্যারিকেন) এর সৃষ্টি হয় এবং তা ঐ মাঝসমুদ্রেই মিলিয়ে যায় তবে তা দুর্যোগ হিসেবে প্রতিপন্ন হবে কিন্তু তাতে জীবনহানির ঘটনা থাকবে না। একইভাবে জনহীন মরু অঞ্চলে ভূমিকম্প বা ভূমিধস ঘটলে তা দুর্যোগরূপে পরিগণিত হবে কিন্তু সেক্ষেত্রে জীবনহানি বা সম্পদহানির কোনাে সম্ভাবনা থাকবে না। উদাহরণ- ভূমিকম্প ভূমিধস, অগ্ন্যুৎপাত হল দুর্যোগের উদাহরণ।

দুর্যোগের বৈশিষ্ট্য :

  • দুর্যোগ প্রাকৃতিক, ভূমিরূপগত, ভূতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সংযুক্ত ব্রিয়া।

  • এটি সাধারণত ক্ষুদ্র স্কেলে সংঘটিত হয়।

  • দুর্যোগ পরিবেশের গুণগত মানের অবনমন ঘটায়।

  • দুর্যোগ সর্বদা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত না করলেও অল্প বিস্তর জীবনযাত্রার গতিকে রুদ্ধ করে দেয়।

  • ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব ব্যপক মাত্রায় না থাকলেও সামাজিক, প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের অল্পবিস্তর ক্ষতি করে।

  • দুর্যোগ হল বিপর্যয় এর কারণ, বৃহৎ স্কেলে দুর্যোগ সংঘটিত হলে সেটি বিপর্যয় হিসাবে পরিগণিত হয়।

  • দুর্যোগ উপযুক্ত আধুনিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বিপর্যয় হল দুর্যোগের চরম ফল বা পরিণতি। ‘বিপর্যয়’ বা Disaster শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘Desastre’ থেকে। যেখানে Des অংশের অর্থ Bad বা Evil বা মন্দ এবং Astre অংশের অর্থ star বা তারা। অর্থাৎ এককথায় বিপর্যয় বা Disaster হল মন্দ তারা (Bad Star) বা শয়তান তারা (Evil Star)। অতীতে মানুষ বিশ্বাস করত যে শয়তান তারার প্রভাবেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে।

প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট যে-কোনাে তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি ঘটনা, যখন জীবন হানি ও সম্পদ হানি ঘটায় এবং বাইরের বা অপরের সাহায্য ছাড়া যার মােকাবিলা করা সম্ভব হয় না তাকেই বলে বিপর্যয় (Disaster)। বিপর্যয়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন সম্পদহানি ও প্রাণহানি ঘটে অপরদিকে পরিবেশের গুণগত মানও হ্রাস পায়।

কলােরাডাে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের গবেষকদের প্রদত্ত বিপর্যয়ের সংজ্ঞা হল—এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতি এবং একশাে (100) এর বেশি জীবনহানি হবে আর 100 এর বেশি মানুষ আহত হবে, এমন ঘটনা হল বিপর্যয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ভাষায় বিপর্যয় হল—এমন যে-কোনাে ঘটনা যার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মানুষের মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। উদাহরণ—2004 খ্রিস্টাব্দে যে সুনামি ঘটেছিল তার ফলে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা সহ ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী অন্যান্য দেশের প্রায় 3,00,000 লােকের মৃত্যু হয়েছিল।

বিপর্যয়ের বৈশিষ্ট্য :

  • বিপর্যয় কখনও ধীরগতিতে আবার কখনও আকস্মিকভাবে উপস্থাপিত হয়।

  • এর ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার গুরুতর ব্যাঘাত ঘটে।

  • এই ঘটনা মানুষের জীবনযাত্রা ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও আঘাত হেনে জীবনধারণের কঠোর অবস্থা তৈরি করে।

  • এটি বৃহৎ স্কেলে সংঘটিত হয়।

  • বিপর্যয় প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই সংঘটিত হতে পারে।

  • সামাজিক পরিকাঠামাে যেমন রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, আস- বাবপত্র প্রভৃতি বিপর্যয়ের কবলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

  • এর ফলে পরিবেশের গুণগত মানের চরম অবক্ষয় ঘটে, যার কুপ্রভাব দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশে বজায় থাকে।