কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ বা ‘শকুন্তল’ নাটকের কথাবস্তু রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা কাহিনী মহাভারতের আদি পর্বে বর্ণিত হয়েছে। সেই কথাবস্তুর কঙ্কালের ওপরে কল্পনার রক্ত মাংস সংযোজন করে অপূর্ব নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞা কালিদাস তাঁর অমর নাটকটি ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ গড়ে তুলেছেন। অন্যান্য ঘটনার অবতারণায়, কাহিনী বিন্যাসে ও নতুন নতুন চরিত্র সৃষ্টিতে কালিদাস স্বতন্ত্র। মহাভারতে শকুন্তলা নিজেই দুষ্মন্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, আর দুষ্মন্ত সকল কথা স্মরণ করতে পারছেন না, শেষে দৈববাণীতে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে শকুন্তলাকে গ্রহণ করেছেন। ঘটনার সজ্জা কালিদাসে অন্যরূপ। কালিদাসে শকুন্তলা-দুষ্মন্তের প্রণয়ের দূতী অনসূয়া প্রিয়ংবদা সখীদ্বয়—তাঁরাই দুষ্মন্তের কাছে শকুন্তলার জন্ম বৃত্তান্ত ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। শকুন্তলার পুত্র প্রসূত হয়েছে দুষ্মন্ত কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের পর ভগবান্ মারীচের আশ্রমে, দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার শেষ মিলনও ঘটেছে সেখানে।
সর্বোপরি কালিদাসের মৌলিক সৃষ্টি দুর্বাসার অভিশাপ। মহর্ষি কণ্বের অজ্ঞাতে শকুন্তলাকে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করে রাজধানীতে প্রত্যাগমনকালে দুষ্মন্ত কথা দিয়ে যান যে যথাযোগ্য মর্যাদায় শকুন্তলাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন। প্রত্যাশিত কাল পূর্ণ হলেও দুষ্মন্তের প্রেরিত কোনো বার্তা বা লোক না আসায় শকুন্তলা দুষ্মন্তের চিন্তায় যখন তন্ময় ছিলেন, তখন একদিন সাতিশয় কোপপরায়ণ ঋষি দুর্বাসা আতিথ্য কামনায় কণ্ব-কুটির দ্বারে স্বীয় আগমন ঘোষণা করলেও তন্ময়তাবশত শকুন্তলা সে বিষয়ে অবহিত হতে পারেন নি। ক্রুদ্ধ দুর্বাসা শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলেন, যার চিন্তায় সে এমন তন্ময় হয়ে আছে, তিনি সময়কালে শকুন্তলাকে চিনতে পারবেন না। শকুন্তলা এই অভিশাপের কথা জানতে না পারলেও তাঁর সখীদ্বয় সমস্ত শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে ক্রুদ্ধ ঋষিকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করলে ঋষি জানালেন, শকুন্তলা যদি কোনো অভিজ্ঞান (স্মারক চিহ্ন) দেখাতে পারেন, তবেই রাজা তাকে চিনতে পারবেন। সখীদ্বয় নিশ্চিত্ত হলেন যে দুষ্মন্ত শকুত্তলাকে অভিজ্ঞান স্বরূপ যে মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দিয়ে গেছেন, তার সাহায্যেই শাপমোচন হতে পারে। কিন্তু পরে কণ্ঠের অনুমতি নিয়ে গৌতমী এবং দুই শিষ্যসহ শকুন্তলা রাজসকাশে, রাজধানীতে যাওয়াকালীন নদী পার হওয়ার সময় অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয়টি হারিয়ে ফেলেন। দুর্বাসার অভিশাপ প্রভাবে শকুন্তলা আত্মপরিচয় দান সত্ত্বেও দুখস্ত তাঁকে চিনতে পারলেন না, শকুন্তলা অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয়টিও দেখাতে পারলেন না। ফলে শকুন্তলা সম্পূর্ণই প্রত্যাখ্যাতা হলেন, হলেন অপমানিতা, বিফল মনোরথ।
এদিকে একদিন এক ধীবর এক মৎস্যের উদর থেকে রাজনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পেলে তা রাজসকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয় দর্শনে দুষ্মন্তের শকুন্তলা-সম্পর্কিত সমস্ত কথা স্মরণে আসে। তখন অনুশোচনা ছাড়া দুষ্মন্তের আর কিছু করণীয় ছিল না। পরে স্বর্গ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে ঋষি মারীচের আশ্রমে সপুত্র শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের সাক্ষাৎ ও মিলন ঘটে। শকুন্তলা, পুত্র ভরতসহ দুষ্মন্ত রাজধানীতে ফিরে আসেন।
নাট্যকাহিনীর অগ্রগতির পথে দুর্বাসার অভিশাপ কাহিনীকে যেন দুটো ভাগে বিভক্ত করেছে। এই অভিশাপের ফলে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার চাঞ্চল্যময় প্রণয়লীলার পূর্বমেঘ দীর্ঘ বিরহের ফলে প্রৌঢ়ী প্রেমের উত্তরমেঘে অবসিত হয়েছে। পূর্বমেঘের ফুল উত্তরমেঘের ফলে পরিণত হয়েছে। দুর্বাসার এই অভিশাপের ফলে রাজার মোহ বিভ্রান্তি ঘটেছে, পূর্ব প্রণয়ের কোনো কথাই স্মরণ করতে পারেন নি; এই অভিশাপ শকুন্তলাকেও বিষয়াভিজ্ঞ করে তুলেছে। নাটকীয়তা সৃষ্টিতেও এই দুর্বাসার অভিশাপ একটা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে; কারণ এটি না হলে শকুন্তলা প্রত্যাখ্যাত হতেন না এবং অভিশাপের আগুনে দগ্ধ হয়েই যে জৈব প্রেম শাশ্বত প্রেমে উত্তীর্ণ হল—ভারতীয় প্রেমের এই মহত্ত্বও প্রস্ফুটিত হবার অবকাশ পেত না। আবার এই অভিশাপের জন্যই নদীগর্ভে শকুন্তলার হাত থেকে রাজমুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পড়ে গেল এবং পুনঃপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যেই ষষ্ঠ অঙ্কে যে dramatic relief পরিকল্পিত হয়েছে, তা থেকে পাঠক-দর্শক বঞ্চিত হতেন যদি দুর্বাসার অভিশাপ না থাকতো। সর্বোপরি দুর্বাসার অভিশাপ রাজা দুষ্মন্তকে কামুকতার অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দান করে পাঠক দর্শকদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে এবং মহাভারতের দুষ্মন্ত থেকে শকুন্তলা নাটকের দুষ্মন্তকে ভিন্ন চরিত্র হিসেবে গড়ে তোলে।
Leave a comment