মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পৃথিবীতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও তাকে রক্ষা করার জন্য এবং নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্যোগী হন। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি কংগ্রেসের সামনে প্রদত্ত ভাষণে সমস্ত ধরনের গােপন কূটনীতির অবসান, বিভিন্ন রাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রতিযােগিতা হ্রাস, উপনিবেশ সমূহের স্বাধীনতা প্রদান ও একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। উইলসন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হওয়ার জন্য তিনটি কারণকে প্রধানত দায়ী করেন, সেগুলি হল一
[1] গোপন কূটনীতি: গােপন কূটনীতি বলতে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধকালীন কূটনীতিকে বােঝায়। এর ফলে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্টি হয় তিক্ততা, যার মধ্যে নিহিত থাকে ভবিষ্যতে যুদ্ধের বীজ।
[2] বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর প্রতি অবিচার: এই প্রবণতা দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পৃথিবীর অনুন্নত অনগ্রসর অঞ্চলের মানুষকে পদানত করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত দ্বারা জাতীয়তাবাদের অবমাননা করা হয়।
[3] স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র: তা ছাড়া প্রাক-প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, ফলে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার অধিকার ব্যাহত হয়।
উড্রো উইলসন এই অবস্থা নিরসনে এবং সুস্থ আন্তর্জাতিক বিশ্ব গঠনের স্বপ্ন নিয়ে তিনটি বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন করেন।
- প্রথমত, গোপন কূটনীতির পরিবর্তে মুক্ত ও পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিবাদের মীমাংসা করা।
- দ্বিতীয়ত, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এই আদর্শ নিয়ে প্রত্যেক জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে হবে। এক জাতি-এক রাষ্ট্র- এই নীতি অনুসরণ, স্বাধীনতা ও সমতার ভিত্তিতে সমস্ত পদানত জাতিকে মুক্ত করে তাদের পৃথক রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে জাতীয়তাবাদের জয় ঘােষণা করতে হবে।
- তৃতীয়ত, প্রত্যেক দেশের রাজনীতিতে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উপরােক্ত তিনটি উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য উইলসন তার বিখ্যাত চোদ্দো দফা শর্ত বা নীতি ঘােষণা করেন।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন মার্কিন আইনসভা কংগ্রেসের সম্মুখে তার চোদ্দো দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবে সর্বপ্রকার গােপন কূটনীতির অবসান, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, উপনিবেশ গুলি স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়। উইলসন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তারের ব্যাপারে বিশেষভাবে আশাবাদী ছিলেন। তার চোদ্দো দফা প্রস্তাবকে স্র্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে মনে করা হয়।
[4] দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪ খ্রি.) থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯ খ্রি.) পর্যন্ত দীর্ঘ দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বা বিশ্বরাজনীতিতে যেসকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, মূলত তাকে কেন্দ্র করেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি সুশৃঙ্খল পাঠ্যবিষয় বা পৃথক শাস্ত্র হিসেবে গড়ে ওঠে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতবর্গ মনে করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ইউনিয়ন অফ ডেমোক্রেটিক কন্ট্রোল (Union of Democratic Control) নামক একটি মানব সংগঠন সর্বপ্রথম আন্দোলনের মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণের দাবি জানায়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তাধারা বিশেষভাবে পরিবর্তিত হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের শান্তির জন্য অনুশাসন তত্ত্ব (Decree on Peace) গৃহীত হয়। লেনিন তার রচনায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে, শাসক শ্রেণির স্বার্থে এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় এবং সেইমতাে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শুরু হয়ে যায় প্রকাশ্য কূটনীতি (Open Diplomacy)-র যুগ। প্রসঙ্গত বলা যায়, একটি পৃথক শাস্ত্র বা পাঠ্য বিষয় হিসেবে এই সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশােনা এবং গবেষণা শুরু হয়ে যায়।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন কর্তৃক প্রদত্ত চোদ্দো দফা প্রস্তাব বা ভাষণ’, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল – অস্ত্র হ্রাস, গােপন কূটনীতির অবসান, আন্তর্জাতিক স্তরে জোটগঠনের মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তা ও সমমর্যাদা প্রদানের নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট উইলসনের চোদ্দো দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় প্রকাশ্য কূটনীতি (Open Diplomacy), যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চর্চাকে প্রভাবিত করে। আবার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পপতি ডেভিড ডেভিসের অর্থসাহায্যে উড্রো উইলসন চেয়ার নামে একটি অধ্যাপক পদ তৈরি করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে পৃথক শাস্ত্র হিসেবে গড়ে তােলার প্রথম প্রয়াস দেখা যায়।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ব্রাইস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তার বক্তব্য রাখেন, যা পরবর্তীকালে সেই বক্তৃতা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও এই সময়েই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ই এ ওয়ালস্-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক Se The History and Nature of International Relations ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় Royal Institute of International affairs। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সমমতাদর্শী গােষ্ঠীর উদ্ভব হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় আর এল বিউয়েলের লেখা ‘International Relations’। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভা শহরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পঠনপাঠন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে Graduate Institute of International Studies তৈরি হয়। এখানে বিশ্বের মধ্যে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলােচনার জন্য অধ্যাপক তৈরি করা হয়। এভাবে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি পৃথক শাস্ত্র হিসেবে বিকাশলাভ করে এবং ভবিষ্যতের পথে এগােতে থাকে।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে আরও কতগুলো আলােচ্য বিষয়সূচি হল一
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ক্ষমতায় রাজনীতির ব্যবধান বৃদ্ধি।
- উত্তেজনা ও যুদ্ধের প্রবণতা প্রশমনের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন সৃষ্টি।
- রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান।
- যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান ও শান্তি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি। এইভাবেই ধীরে ধীরে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিকাশলাভ করে।
Leave a comment