দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ গল্পটিতে আধুনিক যুগযন্ত্রণার প্রতিবিম্বন ঘটেছে। নিতান্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিভূ কাঞ্চন ও রেখার একটি বিশেষ দিনের ঘটনার ভিত্তিতে লেখক তুলে ধরেছেন যুগ মানসিকতা চিত্র— যেখানে হৃদয়বৃত্তিও চলে হিসেবের কড়ি মিলিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রথযাত্রা’ নাটিকায় যেমন বলেছিলেন,
“এযুগে পুষ্পধনুর ছিলেটাও
বেনের টানেই দেয় মিঠে সুরে টঙ্কার।
তার তীরগুলোর ফলা বেনের ঘরে শানিয়ে না আনলে
ঠিক জায়গায় বাজে না বুকে।”
এখানেও ঠিক সেই রকম মাপা হিসেবে চলেছে জীবন যাপন। যুগের বাস্তবতায় কাঞ্চন-রেখা তাদের রেজিস্ট্রি বিয়ের এক বছর পরেও অর্থাৎ বিবাহবার্ষিকীর দিনেও বুঝতে পারে। তিনশো পঁয়ষট্টি পার হয়ে গেলেও কেউ কারো মনকে, ইচ্ছাকে শরীরকে চিনতে পারেনি। এবং প্রতি মুহূর্তে তারা চলেছে হিসেব করে করে। কথায় হিসেব, চলায় হিসেব, অবসরের হিসেব, বাসের টিকিটের হিসেব, গাড়ী ভাড়ার হিসেব এত হিসেবের মধ্যে পড়ে তাদের প্রেম, তাদের হৃদয়বৃত্তি নিষ্পেষিত। তাই প্রেম ভাবনার তুলনায় তারা হয়ে উঠেছে আবেগহীন বুদ্ধিজীবী। অনেক বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে, অনেক রাতের একাকীত্বের পরেও তারা যখন মিলিত হয়, তখনও পারস্পরিক আকর্ষণের তুলনায় যৌক্তিকতা তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রেমাবেগ তারা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে হিসাবের তুলাদণ্ডে। নায়ক কাঞ্চন কখনোই নিজেকে বলিষ্ঠ ভাবে সামনে এনে দাঁড় করাতে পারে না। অর্থনৈতিক চাপে সে তার নিজস্বতা হারিয়ে তত্ত্বকথায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখে। তাই ফুলের মালা কিনতে সে সাহসী হতে পারে না, রেখাকে পরানো বিয়ের দিনের মালাও তার হাত থেকে খসে পড়ে। সে মালা উদরস্ত করে কোনো এক স্থবির বলদ।
রেখার সঙ্গে কাঞ্চনের সম্পর্ক কী— রেজিস্ত্রী বিয়ের এক বছর পরেও কাঞ্চন তা কাউকে জানাতে পারে না। ইচ্ছে করে চীৎকার করে সকলকে শুনিয়ে বলে ‘রেখা আমার ধর্মপত্নী’ কিন্তু পারে না। কারণ, বিয়ে করার পরেও সে রেখাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে নি। জায়গা জমি ধরে রাখার মতো যেন আগাম কিছুর বিনিময়ে রেখাকে সে ধরে রেখেছে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে। সরকারী মতে বৈধ স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও রেখার সঙ্গে বাসে এক জায়গায় সে বসতে পারে না, অদম্য আগ্রহ থাকলেও নির্জন অবকাশে হাত ধরতে পারে না রেখার, সাহস করে একটা মালা রেখার চুলে পরিয়ে দিতে পারে না, ঘোড়ার গাড়ির নির্জন কামরাতেও দুজনে বসে দূরত্ব বজায় রেখে। এমন কি ঘোড়ার গাড়ীর গাড়োয়ানের কাছে অশ্লীল ইঙ্গিতে ভৎসিত হলেও সেই অপমান উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়।
আসলে কাঞ্চনদের যৌবন বলে কিছু নেই। শৈশবের পরেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে তারা প্রৌঢ়ত্বের গোধূলিতে পৌঁছয়। এই বালা ও প্রৌঢ়ত্বের মাঝখানের সমুদ্র প্রমাণ ইচ্ছা-অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, কর্তব্যের অনুরোধ সমস্তই যুগযন্ত্রণা, অস্থিরতা, রূঢ়কার্কাশ্যের পোকায় কাটা। তারা পৌরাণিক যুগের অশ্বমেধের ঘোড়ার মতোই মহানযজ্ঞে প্রাণদান করার জন্যে তথা নিজের জীবন যৌবন সুখ সম্পদ উৎসর্গ করার জন্যে নিবেদিত প্রাণ। তাই তাদের মনে বিগলিত ভাব বলে কিছু নেই। সমস্ত কিছুই পরিমিত গণ্ডীতে আবদ্ধ। তাদের কাছে রেজিস্ট্রারের চেম্বারটা— ছোট ঠাসা, রেস্তরাঁর কেবিনটা—ছোট ঠাসা, শোবার ঘরটা— ছোট ঠাসা। এই মাপা সময়ের মাপা অবস্থার যুগযন্ত্রণার ছবিই উঠে এসেছে আলোচা গল্পটির মধ্যে। লেখকও রচনা কৌশলের মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন এক যন্ত্রণা কাতর যুগে সকলেই কাঞ্চন। লেখক নিজেকেও তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারছেন না। তাই রচনার ভঙ্গির মধ্যে উত্তমপুরুষ প্রথমপুরুষের বয়ান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই সমস্ত দিক থেকে বিচার করলে সমালোচকের মন্তব্যের সাপেক্ষে অভিমত জ্ঞাপন করা যায়।
Leave a comment