অথবা, বাংলা নাটকের ইতিহাসে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।
অথবা, দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যরচনার বিবরণ দিয়ে বাংলা নাট্যসাহিত্যে তাঁর বিশিষ্টতা নির্দেশ করো।
সেক্সপীয়র তাঁর পূর্বতন নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর বহু নাট্য মালঞ্চ থেকে ভাবকুসুম আহরন করেও যেমন এলিজাবেথীয় যুগের বিশ্ববন্দিত নাট্যকার রূপে দেশে দেশে নন্দিত হয়েছেন, তেমনি দীনবন্ধু মিত্রও অগ্রগতি পথিকৃৎ মধুসূদনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও মাইকেলী যুগের শ্রেষ্ঠতম নাট্যকার রূপে দিকে দিকে বন্দিত। দীনবন্ধু মিত্র জীবনকে দেখেছেন গ্রাম-বাংলার সহজ বিকর্ণতায়, নির্মোকহীন জনতার ভাঙ্গাচোরা মুখের কথায় এবং জীবন ও হাস্যরসিকের অন্তর্ভেদি দৃষ্টিক্ষেপে।
১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম নাটক ও বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অনশ্বর গ্রন্থ ‘নীলদর্পন’-এর বিপ্লবী আবির্ভাব। এই নাটকটিকে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তুলনা করেছেন পাশ্চাত্যের মহিলা ঔপন্যাসিক স্টো (stow) রচিত ‘Uncle Tom’s Cabine’ – এর সঙ্গে। স্বদেশীকতা, নীলচাষ, আন্দোলন, নাট্যসাহিত্য, নাট্যমঞ্চ সমস্ত দিক থেকে ‘নীলদর্পন’-এর ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। নাটকটি নীলচাষ বন্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহন করেছিল।
দীনবন্ধু মিত্রের পরবর্তী নাটকগুলি হল– ‘নবীন তপস্বিনী’(১৮৬৩), ‘সধবার একাদশী’(১৮৬৬), ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’(১৮৬৬), ‘লীলাবতী’(১৮৬৭), ‘জামাই বারিক’(১৮৭২), ও ‘কমলে কামিনী’(১৮৭৩) প্রভৃতি।
‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকটি একখানি বিশুদ্ধ মিলনান্তক নাটকের মধ্যে নাট্যকার যে কৌতুক রসের উদ্বোধন ঘটিয়েছেন, তাতে নাট্যকারের জীবনরস-রসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই নাটকে জলধর চরিত্রটি নিজস্বতায় বিশিষ্ট।
‘লীলাবতী’ নাটকে নাট্যকার দীনবন্ধু সাময়িক মিলনসংক্রান্ত কাহিনীকে স্থান দিয়েছেন। কয়েকটি রংদার মর্কট শ্রেণির চিরত্র চিত্রায়নে নাট্যকার দক্ষতা প্রদর্শন করলেও সেখানে তিনি রোমান্টিক প্রেমিক-প্রেমিকার চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘কমলে কামিনী’ নাটকটি কাহার প্রদেশের একটি ঐতিহাসিক কাহিনীর পটভূমিকায় রচিত রোমান্টিক প্রণয়মূলক কাহিনী। এই নাটকটির ক্ষেত্রেও নাট্যকার দক্ষতার প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যপ্রতিভা মূলত কয়েকটি প্রহষনধর্মী নাটককে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয়েছে।
‘সধবার একাদশী’ নাটকের শুরু কাঁকুরগাছি নকুলেশ্বরের উদ্যানে এবং শেষ কাঁছাড়ি পাড়ায় অটল বিহারীর বৈঠকে। দীনবন্ধু এখানে তুলে ধরেছেন পরিপূর্ণ জীবন, তার লোভ, মিথ্যাচার ভন্ডামি, ধূর্ততা তিনি দেখিয়েছেন। এক প্রতিভাবান যথার্থ জ্ঞানি ও যোগ্য লোক না পারিবারিক জীবনে না সামাজিক জীবনে কোনরূপ স্বীকৃতি পেল। এই ব্যর্থ, নিস্ফল, নৈরাশ্যপিড়িত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দ্বিধাশূন্য উচ্চহাস্যই এই নাটকের প্রান।
‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটকে প্রথমদিকে স্থুল-বাহ্য জীবনকে প্রাধান্য দান তারপর আচরণ বা আবরণ ছেড়ে ব্যক্তি-স্বরূপকে ধরার চেষ্টা এ নাটকে লক্ষ্যনীয়। ষাট বছরের বুড়ো রাজীবের পনেরো বছরের বয়স্কা বিধবা কন্যা আছে, কিন্তু পুনর্বিবাহে উৎসুক। আর সে কারণেই ব্যাঙ্গ ক্রমশ তুঙ্গে উঠেছে।
‘জামাই বারিক’ নামক প্রহষনটির আক্রমনস্থল সেকালের ধনী পরিবারে ঘরজামাই করার প্রবনতা। জামাই বাবাজীদের চরিত্র, দুই সতীনের কলহ প্রভৃতির কৌতুক বর্ণানার মধ্য দিয়ে প্রহষনটি চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।
সুতরাং, পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশে এবং নির্মল হাস্যরস সৃষ্টিতে দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাটকে দোসরহীন ব্যক্তিত্ব।
Leave a comment