অথবা, ‘দি রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ প্লেটো তার ন্যায়ধর্মভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্রের বাস্তবায়নে শিক্ষার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। নিঃস্বার্থ মন নিয়ে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্পাদনের উপযােগী করে নাগরিকদের গড়ে তােলার উদ্দেশ্যেই প্লেটো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন। প্রফেসর বার্কার প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থাকে সামাজিক ন্যায় ধর্ম ও সত্যানুসন্ধানের একটি মাধ্যম বলেছেন।
শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতিঃ প্লেটোর মতে, শিক্ষার প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিকে তার পুরােপুরি সত্তায় বিকশিত করা এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করার উপযােগী করে তােলা। তার মতে আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা ইচ্ছাধীন হতে পারে না। অভিভাবকদের জন্য শিক্ষা অবশ্যই বাধ্যতামূলক হতে হবে। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, স্বাভাবিক যােগ্যতার দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে মূলগত কোনাে পার্থক্য নেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তারা অভিন্ন।
শিক্ষার গুরুত্বঃ প্লেটো বলেন, ধাতুর মধ্যে স্বর্ণ যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ তদ্রুপ মানবকুলের মধ্যে দার্শনিক প্রভুরাও সর্বশ্রেষ্ঠ। আর দার্শনিক প্রভু গড়ে তােলার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা। একমাত্র সুশিক্ষায় শিক্ষিত দার্শনিক প্রভুরাই পারেন আদর্শ রাষ্ট্রের সফলতা আনয়ন করতে। শুধু তার ধারণাতেই নয় বরং সামগ্রিকভাবে গ্রীকদের ধারণায়ও শিক্ষাকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
শিক্ষার কারিকুলাম ও বিভিন্ন স্তরঃ প্লেটোর শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে সর্বাত্মক। প্লেটো তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রধানত দু’টো ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (ক) প্রাথমিক শিক্ষা ও (খ) উচ্চ শিক্ষা। এ বিভাগ মূলত বয়সের ভিত্তিতে গঠিত হয় এবং বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম শিক্ষাদান করা হয়।
(ক) প্রাথমিক শিক্ষাঃ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর অন্তরে মহৎ ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা। জন্মের পর হতেই প্রতিটি শিশু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা গ্রহণ করবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শাসক ও শাসিতের সন্তানগণকে একই প্রকার শিক্ষা লাভের সুযােগ দান করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রধানত, দুটি পর্যায়ে বিভক্ত থাকবে। যেমন- (১) সঙ্গীতমূলক শিক্ষা শৈশব ১৮ বছর (২) ব্যায়ামমূলক শিক্ষা ১৯-২২ বছর।
(১) সঙ্গীতমূলক শিক্ষাঃ এই স্তরে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদাতাগণ শিশুর অপরিণত মানসিক বৃত্তিগুলি বিকশিত করে তুলতে সাহায্য করে। এই পর্যায়ে হালকা ও সহজবােধ্য কবিতা, গল্প পাঠ, সংগীত চর্চা ও প্রাথমিক গণিত চর্চার মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের সুযােগ লাভ করবে। এই শিক্ষা কিশােরদের নিকট আনন্দময় করে তােলা উচিত। প্লেটোর মতে জবরদস্তিমূলক শিক্ষা মনের কোনাে উন্নতি বিধান করতে পারে না।
(২) ব্যায়ামমূলক শিক্ষাঃ এই পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীগণ শারীরিক ব্যায়াম বা দেহচর্চা ও সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আত্মসংযম, শৃংখলাবােধ, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রমী হবার গুণাবলী অর্জন করতে সমর্থ হবে। এই সময়ে অন্য কোন বিষয়ে অধ্যয়নের সুযােগ থাকবে না। প্রাথমিক শিক্ষার শেষে একটি বাছাইমূলক পরীক্ষা হবে। এই পর্যায়ে যারা আধকতর ধীশক্তি, প্রজ্ঞা, শিক্ষার প্রতি আসক্তি প্রদর্শনে সক্ষম বলে বিবেচিত হবে তারাই উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারবে।
(খ) উচ্চশিক্ষাঃ প্লেটো উচ্চশিক্ষাকে ৩টি স্তরে ভাগ করেছেন যা নিম্নে আলােচনা করা হলাে –
(১) ২১-৩০ বছরঃ উচ্চতর গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বাস্তব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেয়া হবে। এটাই এই পর্যায়ের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। এই দশবছর শিক্ষাকালে গণিত শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। শিক্ষার পরিসমাপ্তি এখানেই ঘটবে না।
(২) ৩০-৩৫ বছরঃ পূর্বের পর্যায়গুলাে যারা সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পারবে সেই কৃতী শিক্ষার্থীদের এই ৫ বছর একাগ্রভাবে উচ্চতর দর্শন, তর্কশাস্ত্র, অধিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে হবে। এই সকল বিষয় অধ্যয়নের ফলে শিক্ষার্থীরা সকল জ্ঞানের মধ্যে কার ঐক্য সূত্র কী তা জানার প্রয়াস পায়। এর পূর্বে উচ্চতর দর্শন সম্পর্কে কোনাে শিক্ষা দেয়া হবে না। কারণ পরিপক্ক বয়স ব্যতীত দর্শনের গুরুত্ব উপলব্দি করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভবপর নয়।
(৩) ৩৫-৫০ বছরঃ এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে সরকারী কার্যে ও যুদ্ধকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। এই দীর্ঘ ৫০ বছরের জ্ঞান সাধনা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ স্বাভাবিকভাবেই দার্শনিক হিসেবে গুণাবলী পূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে সক্ষম হবে। তারা এবার তাদের সমস্ত শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরম উত্তমের জ্ঞান লাভ করবে। পরম উত্তমের জ্ঞানই হচ্ছে শাসক হওয়ার একমাত্র শর্ত।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এতসব সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা সম্পর্কে তার মত মৌলিক গবেষণা এ যাবৎ আর কোন চিন্তাবিদ করতে পারেননি। তার এই শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিই এক অনবদ্য অবদান। প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থাকে গুণগত দিক থেকে নয় পরিমাণগত দিক হতে কিঞ্চিত পরিবর্তন করলেই তা বর্তমানের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এবং সর্বকালের সকল শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রয়ােগযােগ্যতা লাভ করবে।
Leave a comment