এ গল্পের প্রধান চরিত্র ফতিমাদি, যাকে লেখক চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহিলা যোদ্ধা রূপে। প্রতিবেশী সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু। তাঁর গল্পে চমক লাগাতে অকস্মাৎ বলে উঠেছেন—“একটা গল্পের মনে আছে ১৯৩০ সালের সেই সভার কথা। স্কুলের পেছনের কয়েকজন লোক বসেছিলেন। দশ এগারো বছরের একটি মেয়ে লেকচার দিচ্ছিল ।… শুনেছিলাম, সোনাপুরের মৌলবি সাহেবের মেয়ে।”

এটা ছিল লেখকের ফতিমা দিকে দেখা প্রথম দিনের কথা, এরপর লিখেছেন—“1934 এর প্রলয়ংকর ভূমিকম্পের পর দ্বিতীয়বার দেখলাম। চার বছরে অনেক বড়ো দেখাচ্ছিল। মহাত্মা গান্ধি ওপর গান্ধিজির কাছে দাঁড়ানো মেয়েকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রার্থনাসভায় কোরান শরীফের আঘাতগুলি সুর করে পাঠ করছে মৌলবি সাহেবের কন্যা। সম্প্রতি দু-বছরের সাজা ভোগ করে জেল থেকে বেরিয়েছে। লোকে বলে, গ্রেফতারির সময় পুলিশের লাঠিতে গুরুতর ভাবে আহত হয়েছিল।

এই হল লেখকের ফতিমাদি এবং তার কর্মপথ, আজ বহু বছর পর এই ফতিমাদিকে লেখক আবিষ্কার করেন অন্যরূপে। ‘আপাদমস্তক বেরখায় ঢাকা দুই মহিলা আর সঙ্গে ন দশ বছরের পুতুলের মতো সুন্দর একটি মেয়ে। লেখক তাঁর ফতিমাদিকে চিনতে ভুল করেননি। তবে ফতিমাদিকে তো ভোলা যায় না। 1937 সালে তৃতীয়বার ফতিমাদিকে স্কুলের মাঠে এক রাজনৈতিক সম্মেলনে দেখে তিনি সেদিন প্রথম ‘ফতিমাদি’ বলে ডেকে উঠেছিলেন। ক্রমেই লেখক তাঁর ফতিমাদির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। অতি কাছ থেকে সেদিন ফতিমাদিকে দেখেও আজকের দেখার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। কারণ, “গ্রেফতার হবার সময় পুলিশ সার্জেন্টের অকথ্য গালিগালাজের জবাব দিতে গিয়ে তাঁর মুখমণ্ডলে যে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছিল 1947-এ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোঝবার সময় তাঁর মুখমণ্ডলে যে আভা ছেয়ে থাকত, সবকিছুকে খয়েরি রঙের বোরখায় কী করে ঢেকে দিল? এ কেমন করে হল?

লেখকের নাম অজিত হলেও ফতিমাদি তাঁকে আজিজ নামে ডাকতো। বহুদিন পর হঠাৎ তাঁদের সাক্ষাৎ হওয়ায় বর্তমান ঠিকানা আদায় প্রদান হয়ে যায়। লেখক ফতিমাদির আমন্ত্রণ পেয়ে আগে সামলাতে না পেরে একদা ফতিমাদির দানিশ-মঞ্জিলের সিঁড়িতে পা রাখেন। তবে যে আশা নিয়ে তিনি এমনভাবে ছুটে এসেছেন—তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে সেদিনের মতো ফতিমাদি সামান্য সৌজন্যমূলক আচরণ সেরে লেখক বিদায় জানিয়েছিল, লেখক এমন প্রীতিহীন আচরণে মনে মনে ভাবতে থাকলেন—“এ মহিলা আমার ফতিমাদি নন। আর কেউ”

কিন্তু লেখকের এই ভ্রান্ত ধারণা বেশিদিন মনে মনে পোষণ করতে হয়নি। একদিন তিনি বাড়িতে ফিরে দেখেন অজাচিত ভাবে ফতিমাদি এসে তাঁর ফ্ল্যাট আলো করে বসে আছে। বোরখা মেঝেয় পড়ে আছে। তবে বোরখা নয়, নেকড়ার ফালি আর ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। লেখক বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে পারেনি—“এ কী করে হল।” অতঃপর প্রীতিপূর্ণ আলোচনার পর লেখক আবেগ রোধ করতে না পেরে জানতে চাইলেন—“আপনি ছিলেন কোথায় ? কোথায় আছেন ?” এবং আরও জানতে চাইলেন আপনি পলিটিক্স ছেড়ে কেন পরিবারের সামিল হলেন। এবার ফতিমাদি আর ধৈর্য ধরতে না পেরে বলে ফেলল—“তোমার নেতাদের কাছে জবাব তলব করোনি কেন? কাল অবধি যারা গান্ধি নেহরু প্যাটেলকে খোলাখুলি গাল দিয়ে এসেছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে, সেই বিভেদবাদী লিডারদের সমান মর্যাদা দেওয়া হল আর দেশের জন্য যারা প্রাণ দিল, তাদের দুধে পড়া মাছির মতন তুলে ফেলে দেওয়া হল। আজ ফতিমাদি এমনভাবে নীরব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জানালো—“ওই পাষণ্ডরা আমার ওপর কী কী “উৎপীড়ন চালিয়েছে তুমি কী জানবে ? আর আমি কার দোরে কড়া নাড়িনি ? কিন্তু দিল্লি থেকে পাটনা পর্যন্ত সর্বত্র ভাগ্যবিধাতারা আমার বুদ্ধির চিকিৎসা করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বিয়ে করে বাচ্চা প্রসব করার উপদেশ দিয়েছেন। আর শেষ পর্যন্ত শাসানি।”

এই হল তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রকৃত অবস্থা, পরিণতি, প্রাপ্তি। কিন্তু ফতিমাদি তার মধ্যেকার প্রতিভাকে অবস্থার প্রতিকূলতায় ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও একদা সময় বিশেষে আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। টাউন হলে ন্যাশালিস্ট মুসলিম কনফারেন্সের প্রস্তুতি ধুমধাম করে হচ্ছে। অপর পক্ষে এই কনফারেন্সের বিরোধিতা করতে ভিন্নধর্মীরা পেপারে সমাচার ছাপছে। তর্ক বিবাদ ক্রমে বেড়ে চলেছে। কনফারেন্সের দিন ‘টাউনহলের সামনে রাস্তার দু’দিকে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে ধ্বনি দিচ্ছে। গালাগালি, শ্লোগান আর থেকে থেকে ইট পাথরের বর্ষণ। মনে হল 1942-এর সেই দিনগুলো ফিরে এসেছে। এরই মাঝে একটা নারী কন্ঠের ধ্বনি ভেসে এলো— “মহাত্মা গান্ধিজি জয়! দাঙ্গাবাজরা ধেয়ে এল মহিলাটির দিকে। গাল পাড়ল—কুত্তি! ‘মেয়েটি স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে। তার গতিরোধ করতে ‘দুর্বৃত্তরা তাকে মাটিতে ফেলে চুলের মুটি ধরে হেঁচড়াতে লাগল। পুলিশ নীরব দর্শক। মেয়েটির কাপড় চোপড় সমস্ত খুলে গেছে, শুভানুধ্যায়ীরা চোখে হাত চাপা দিল।

মেয়েটি ছিল—ফতিমাদি, ‘কদর্য রাজনীতির বলি’। লেখক হসপিটালে তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়েছেন—“জানোয়াররা ফতিমাদির মুখে অ্যাসিডের শিশি উপুড় করে দিয়েছিল। মুখ ঝলসে কালো হয়ে গেছে। একটা চোখ খারাপ হয়ে গেছে, হাতের হাড় ভেঙে গেছে।” লেখক ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন—“ফতিমাদিকে কোনও দিন এভাবে দেখতে হবে, আমি কল্পনাও করিনি।” রাজনীতি যে কী কদর্য গ্লানিময় এ গল্পটি তারই প্রতিভূ।