দারিদ্র্য কবিতার প্রথমেই কবি দারিদ্র্যকে সম্বোধন করে বলেছেন ‘তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান’। খ্রিস্ট হলেন একজন প্রতীচ্যের মহামানব। যিনি বেথেলহেম শহরের এক গোশালায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছুতোর ব্যবসায়ী—মাতাও এই কাজে পিতার সহযোগী হ’তেন। যীশু জন্মেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে কিন্তু সারা বিশ্বে তাঁর প্রেমের মন্ত্র ছড়িয়ে গেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে (He came to establish the kingdom of good on earth – a kingdom of love, merey and Justice” — যিনি জগতে শান্তি ও প্রেমের রাজ্য চেয়েছেন তিনি তাঁর মধ্যে যৌবনে উত্তর—তিরিশেই রাজা ও জনতার রোষে পড়েন ও একজন শিষ্যের বিশ্বাসঘাতকতায় কাঁটার মুকুট মাথায় পরে নিজের ক্রুশ নিজে বহন করে নিয়ে যান। এবং তৎকালীন নিষ্ঠুর মৃঢ় মানুষরা তাকে ক্রুশে পেরেক মেরে মেরে ফেলে যদিও তিনদিন পর তাঁর পুনরুজ্জীবন হয় সে আলাদা ঘটনা। যীশুর মত কবিও কাঁটার মুকুট পরে দারিদ্র্যকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এই জোরেই যীশু এত মহীয়ান। আর কবিও নিজেকে দারিদ্র্য-পীড়িত ভাবেন নি খ্রীস্টের মত তিনি যে কাঁটার মুকুট পরে আছেন তা তাঁকে সম্মানিত করেছে। দুর্বাসা হ’লেন ভারতবর্ষের এক পৌরাণিক ঋষি। তপঃপ্রভাবে তেজস্বী ঋষি হ’লেও এঁর ক্রোধে ইন্দ্র পর্যন্ত শ্রীভ্রষ্ট হন। এঁরই শাপে শকুন্তলা দুষ্মন্তকে প্রথমে স্বামীরূপে লাভ করতে পারেন নি। তাঁর অনেক কাহিনির মধ্যে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আছে রামচন্দ্র মর্ত্যধাম ত্যাগের পূর্বে যখন কালপুরুষের সঙ্গে বাক্যালাপে নিযুক্ত সেই সময় দুর্বাসা রামের সাক্ষাৎপ্রার্থী হ’ন। রাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তাদের কথোপকথনের সময় কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এলে রাম মৃত্যুবরণ করবেন। দুর্বাসার অভিশাপের ভয়ে লক্ষ্মণ রামকে পরামর্শস্থানে উপস্থিত হয়ে ঋষির আসার সংবাদ জানান। দুর্বাসা হলেন দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তির মতো কঠিন তাই সরযূসলিলে রাম দেহত্যাগ করেন।

ঐতেরীয় সংহিতায় লক্ষ্মী ও শ্রীকে আদিত্যের দুই স্ত্রীরূপে দেখানো হয়েছে। রামায়ণের মতানুসারে পদ্মহস্তা লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে ওঠেন। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের ফলস্বরূপ ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী দেখা দেন। দক্ষকন্যা খ্যাতির কন্যা লক্ষ্মী। নারায়ণের স্ত্রী তিনি তাই তাঁর নাম নারায়ণী। দুর্বাসার শাপে ইন্দ্ৰ যখন শ্রীভ্রষ্ট হ’ন তখন সর্বসৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী সমুদ্রে প্রবেশ করেন। সারদা হলেন দেবী সরস্বতী। ইনি শ্রুতি—শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। কবিদের ইনি ইষ্টদেবী। সরস্বতী কৃষ্ণকণ্ঠ থেকে উদ্ভূতা। সমস্ত নরনারীর হৃদয়ে এই দেবী জ্যোতি সঞ্চার করেন। সুন্দর ও সুবাক্যের ইনি প্রেরণাদাত্রী। মাইকেল মধুসূদনও এই শ্বেতভুজা দেবীর বন্দনা করেছেন তার সাহিত্যিক মহাকাব্য লেখার প্রাক্কালে।

দুর্বাসা যেমন ক্রোধাগ্নিতে সকলের সংহার করেন তেমনি কবির জীবনের সমস্ত শ্রী ও ঐশ্বর্যের সংহারক প্রতীকি দুর্বাসা ঋষি। সারদা সরস্বতী। সার—শ্রেষ্ঠাংশ দা-দান করা। বাগ্‌দেবীর বীণায় নানা রাগরাগিণীর সুরঝংকার ওঠে কিন্তু কবির কাব্যসরস্বতী দারিদ্র্যের দুঃসহ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শুধু আর্তনাদ করে গেছেন কবির কবিতায়। মিথের ভাবনায় ভাবিত এই কবিতা। উমার আগমনী গানের বিপরীতে দারিদ্র্যের দুঃখ কবিতাতে একটা নতুন অনুষঙ্গে যুক্ত। মিথের অনুরণন শোনা যায় যখন নজরুল বলেন—

শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান

যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি

অগ্রে আসি কর পান

গ্রিক পুরাণের এক প্রসিদ্ধ রাজা ট্যাণ্টেলাস। দেবতাদের দ্বারা তিনি অভিশপ্ত। যখনই তিনি কোন একটা সরোবর থেকে জল পান করতে যেতেন তখনই তা শুকিয়ে যেত। সরোবরের দুধারের বৃক্ষ ট্যান্টালাস যখন আপেল, ডালিম বা ডুমুর পাড়তে যেতেন তখনই সেই ফলবানবৃক্ষগুলি শাখাসহ অদৃশ্য হয়ে যেত। সারা জীবন তার কবির মতোই তৃথ্বায় ছাতি ফেটে গেছে কিন্তু এককণা জলও তিনি স্পর্শ করতে পারেননি। নজরুলের জীবনরসাস্বাদনের তৃথ্বা ছিল অগাধ। কিন্তু গ্রিক পৌরাণিক রাজা ট্যান্টেলাসের মতই দারিদ্র্য তাঁর কাছ থেকে জীবনের রস নিঙড়ে নিয়েছে।