কবিতার নাম ‘দারিদ্র্য’। বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক নামকরণ কবিতাটির বিষয়বস্তু বিচার বিশ্লেষণ করলেই নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন বিষয়বস্তুকে সামনে রেখেই সার্থকতা বিচার করা যাক।

দারিদ্র্যের নির্মম নিষ্ঠুর আঘাতে জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় । দারিদ্র্যেই জীবনের রঙ-রূপ-রস-প্রাণ শুষ্ক করে দেয়। কবির কল্পলোক ঊষর মরুভূমি করে তোলে। জন্ম থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়। দারিদ্র্যের জন্যই তাঁর শিক্ষা জীবন সংক্ষিপ্ত। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসার সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। পিতার মৃত্যু আবার তার ওপরে সংসারের অভাব কবির জীবনকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছে। দারিদ্র্যের প্রকোপ তার জীবনকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা পারেনি। বরং দারিদ্র্যের দুঃসহ জ্বালায় তাকে মহত্তর জীবনে উন্নীত করেছিল। জীবনের গতিকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিলেও দারিদ্র্যেই তাকে সংগ্রামী করে তুলেছে। দারিদ্র্য কবিকে মহান করেছে, খ্রিস্টের সম্মান দান করেছে। দারিদ্র্য তাকে অসঙ্কোচে আত্মপ্রকাশ করবার প্রেরণা যুগিয়েছে। দুঃসহ জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে মহাশক্তিরূপে দারিদ্র্যের বন্দনা করেছেন।

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। 

তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান 

কণ্টক-মুকুট শোভা। দিয়াছে, তাপস, 

অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; 

উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার, 

বীণা মোর শাপে তবু হ’ল তরবার।

পরের স্তবকে কবি দারিদ্র্য পীড়িত ব্যথাতুর জীবনের করুণ কাহিনি তুলে ধরেছেন। 

দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস, 

অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিল বিরস 

অকালে শুকালো মোর রূপ-রস-প্রাণ। 

শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান

যতবার নিতে যাই হে বুভুক্ষু তুমি 

অগ্রে আসি’ কর পান। শূন্য মরুভূমি 

হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন 

আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ।

কিন্তু দারিদ্র্য কবিকে ম্লান করে দিতে পারেনি। বরং দারিদ্র্যের দুঃসহ জ্বালা যন্ত্রণাই কবি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্যের অভিশাপের জন্যই কবির বীণায় সৌন্দর্যের সপ্তসুর ধ্বনিত হয়ে উঠেনি বরং সেখানেই ঝঙ্কৃত হয়েছে ক্ষুরধার তরবারির শাণিত তীব্রতা।

‘বীণা মোর সাপে তব হ’ল তরবার।

দারিদ্র্য তার জ্বালা যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কবিকে জীবন অভিজ্ঞতার মহত্তর প্রান্তরে উপনীত করেছিল । মহাশক্তি রূপে দারিদ্র্য তার জীবনে নেমে এসেছিল। সেইজন্য মহাশক্তিরূপী দারিদ্র্যের বন্দনা করেছেন। সুতরাং কবিতার নাম তাই ‘দারিদ্র্য’ সঙ্গতই হয়েছে।