‘দারিদ্র্য’ নজরুলের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। কিন্তু কবিতাটি রচনার পশ্চাৎপটে নজরুলের ব্যক্তি-জীবনের দীর্ঘ দুঃখের দিনগুলি মেদুর ছায়া বিস্তার করেছে। পিতার মৃত্যুর পর অভাব-জর্জরিত সংসারে নানারূপ বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে তাঁর বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। গ্রামের মক্তবেই তাঁর লেখাপড়া আরম্ভ হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সংসারের অভাবের প্রয়োজন মেটাতে কখনো গ্রামে মোল্লাগিরি, কখনো মাজার শরীফের খাদেম এর কাজ, কখনো মসজিদের এমামতিও করতে হত। নিরবিচ্ছিন্নভাবে স্কুলে পড়াশুনা করাও নজরুলের ভাগ্যে হয় নি। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করার আগেই সৈনিকের চাকরি গ্রহণ করেন।

পরবর্তী জীবনে মাঝে মাঝে অর্থ-স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখলেও অভাব ও দারিদ্র্যের একটা ছেঁড়া কাঁথা নজরুলের গায়ে জড়িয়ে ছিলই। কৃষ্ণনগরে বাসকালেই নজরুল এই ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি রচনা করেন। নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের জন্ম ও ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটির রচনাকাল বেশ কাছাকাছি। কবিতাটির রচনার পটভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, নজরুল এই সময়ে মাত্র পঁচিশটি টাকার জন্য তাঁর প্রকাশককে করুণ আবেদন জানান। ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি একান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। ১৩৩৩ সালে শরৎকালে কৃষ্ণনগরে আগমনীর করুণ সানাইতে যেন কবির জীবনের ব্যথা-বেদনার কান্না ঝরে পড়ছিল, সেই মুহূর্তের অপর সৃষ্টি ‘দারিদ্র্য’।

কবিতাটিতে দারিদ্র্যের কথা, জীবনের দুঃসহ ভাবের কথা, অভাব অনটনের কথা রয়েছে। কিন্তু নিরাবরণ দুঃখের রুদ্র কঠোর রূপটিই কবিতার একমাত্র বিষয়বস্তু নয়। এ কথা সত্য যে দারিদ্র্যের দুঃসহ ভারে কবির কাব্যসৃষ্টির অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেক কল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। কবির সৌন্দর্য-ধ্যান দারিদ্র্যের তীব্র উত্তাপে অনেক সময়েই বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। দারিদ্র্যরূপী বিষাক্ত নাগের বিষের জ্বালা সহ্য করেই কবিকে কাব্যচর্চা করতে হয়েছে।

কবির আপন জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্জাত দারিদ্র্যের দুর্বিষহ রূপ কবিতাটিকে নিছক দুঃখের তালিকা মাত্র করে তোলে নি। কবির প্রতিভায় সিঞ্চিত হয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক অনবদ্য কবিতা। দারিদ্র্যের দুঃসহ রূপটি কবির কল্পনার মাধুর্যে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্যের বিভিন্ন রূপ কল্পনা করে তাকে জীবন্ত চরিত্ররূপে উপস্থাপন করায় কবিতাটিতে যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে—নিছক বিমূর্ত অবস্থা বা ভাবরূপে উপস্থাপন করলে সেই কাব্যরস ব্যাহত হত এবং কবিতাটি নীতিকথামূলক পদ্যে পর্যবসিত হত। কবি যদি কেবল দারিদ্র্যের ভয়ঙ্কর অন্ধকারময় আত্মহননকারী বেদনাত্মক দিকটি চিহ্নিত করতেন তাহলে কবিতাটি যথার্থ রসোত্তীর্ণ হতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। সম্ভবত তেমন প্রচেষ্টায় কবিতাটি বিবৃতিমূলক চিত্রমালায় গ্রথিত হত। দারিদ্র্যের চরম আঘাত ও দুর্দশা বাস্তব জগতে নিয়তই দৃশ্যমান, কিন্তু তা’ কবিতায় সমর্পিত হতে হলে তা’ রসাস্বাদনযোগ্য ভাবমণ্ডিত হওয়া প্রয়োজন। এখানে নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার উৎকর্ষ কবির একটি বিশেষ ভাবের মধ্যে অন্তরিত হয়ে আছে কিন্তু তা মূর্ত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন উপমাগত রূপকের প্রয়োগে, ফলে তা সহজেই পাঠকচিত্তে সঞ্চারিত হয়ে যায়।

নজরুল বিমূর্ত দারিদ্র্যকে মূর্তিদান করেছেন জীবন্ত মানুষরূপে। আলোচ্য কবিতায় দারিদ্র্যের উপমা একাধিক। দ্বিতীয় স্তবকে কবি-কল্পনায় দারিদ্র্য বুভুক্ষু দর্পী তাপসরূপে দেখা দিয়েছে এবং কবির অন্ন আত্মসাৎ করেছে। তৃতীয় স্তবকে কবি বলছেন দারিদ্র্য নির্মম কাঠুরিয়ার মত কবির আশাবৃক্ষ ছেদন করেছে। চতুর্থ স্তবকে বলা হয়েছে দারিদ্র্য প্রখর সূর্যের মত কবির হৃদয়ের করুণা-নীহার-বিন্দু শুষে নিয়েছে। ষষ্ঠ স্তবকে দারিদ্র্যের দংশনকে নাগদংশনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সপ্তম স্তবকে দারিদ্র্য কোপন-স্বভাব ঋষি দুর্বাসার সঙ্গে উপমিত। আবার কবিতার শেষ পর্বে ‘দারিদ্র্য অসহ পুত্র হয়ে জায়া কাঁদে অহরহ’ কবির দুয়ার ধরি। ক্রন্দনরত কনিষ্ঠা কন্যার মধ্যেও কবি দেখতে পান দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর রূপ। সর্বত্রই উপমাগর্ভ রূপকের প্রয়োগ।

‘দারিদ্র্য’ কবিতাটির মধ্যে দারিদ্র্যকে পৌরাণিক প্রসঙ্গে যে ভাবে মূর্ত করে তুলেছেন তা যেমন সুপ্রযুক্ত হয়েছে, তেমনি হয়েছে উপভোগ্য। তিনটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে—

“তুমি মোরে দানিয়াছে খ্রীস্টের সম্মান 

কণ্টক মুকুট শোভা।”


তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।”


“ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের, দ্বারে দ্বারে ঋষি

ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা।”

এই তিনটি দৃষ্টান্তের মধ্যে প্রথম দৃষ্টান্তে ঐতিহাসিক পুরুষ যীশুখ্রীস্টের এবং তাঁর কণ্টক মুকুটের প্রসঙ্গ উল্লেখ করায় একদিকে যেমন যন্ত্রণাবরণে সত্যনিষ্ঠায় অবিচলতার আভাস রয়েছে তেমনি দারিদ্র্যের মহিমা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে কালীয়নাগের প্রসঙ্গ আভাসিত হয়েছে, যার মধ্যে এক তীব্র বিরোধিতা ও যন্ত্রণার ব্যঞ্জনা রয়েছে। তৃতীয় দৃষ্টান্তে ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্র দুর্বাসা এক ক্রোধী, অসহিষ্ণু এবং অনিষ্ট সাধনকারী ঋষিরূপে আমাদের কাছে খুবই পরিচিত, সুতরাং তাঁর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এবং দারিদ্র্যকে সেই চরিত্রে রূপান্তরিত করে দিয়ে ভাবনাকে কবি আশ্চর্য নৈপুণ্যে ভারতীয় চেতনার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন।

আলোচ্য কবিতাটি মধ্যে কবির পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি একটা ক্রোধ এবং জ্বালা প্রধান হয়ে উঠলেও কোনো কোনো স্থানে অসাধারণ কাব্য-সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে এবং দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে স্বপ্নভঙ্গের বর্ণনায় করণরস সঞ্চারিত হয়ে কবিতাটিকে এক বিশেষ মাত্রা দান করেছে। সৌন্দর্যপিপাসু হৃদয়ের বাসনাকে প্রকাশ করে কবি বলেন—

“আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল

ক’রে উঠে সারা হিয়া, শিশির সজল

ঢল টল ধরণী মত করুণায়।”

কিন্তু দারিদ্র্যের উত্তাপ যে সৌন্দর্যকে বিশুদ্ধ ও ম্লান করে দেয়—

“তুমি রবি তব তাপে শুকাইয়া যায় করুণা-নীহার-বিন্দু। ম্লান হয়ে উঠি

ধরণীর ছায়াঞ্চলে। স্বপ্ন যায় টুটি

সুন্দরের কল্যাণের।”

আলোচ্য কবিতাটিতে দারিদ্র্যের বন্দনা গান করতে গিয়ে কবি রাবীন্দ্রিক রীতি অনুসরণ করেছেন ছন্দ, ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে। এখানে নজরুলের নিজস্ব বলদৃপ্ত ছন্দ বা জোরালো বিদেশী শব্দের অজস্র ব্যবহার নেই। রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে’ বা ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার মত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আলোচ্য কবিতাটি রচিত কিন্তু দারিদ্র্যকে বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণে এবং দারিদ্র্যের উত্তাপে বিপর্যস্ত জীবনযাপন থেকে উদ্ভূত অসাধারণ সংগ্রামী মানসিকতার প্রকাশে কবিতাটিকে আপন স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। দারিদ্র্যকে সম্বোধন করে কবি বলে ওঠেন—

“দু’-নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নিবাণ’

আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান

প্রমোদ কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা-

তোমার আইনে শুধু মৃত্যুদণ্ড লিখা!”

জীবনের মুহূর্তগুলিকে দুঃখের, অভাবের বিপদে ভরে তুললেও এবং দারিদ্র্যকে শোষকরূপে, অভাবরূপে, বিরহবোধরূপে দেখলেও এর মধ্যেই কবি নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। অভাবের মধ্যেই দেখেছেন নতুন ভাবের বীজ। তাই স্পষ্টতঃই দারিদ্র্য কবি মনকে অভিভূত ও হতাশাগ্রস্ত করতে পারে নি বরং দারিদ্র্যকে অবলম্বন করে নজরুল কবিচিত্তের দহনজনিত আবেগকে মুক্তি দিয়েছেন।

এরই ফলে কবিতাটি দারিদ্র্যের এক বিবৃতিমূলক নীতি সর্বস্ব কবিতা না হয়ে হয়ে উঠেছে একটি যথার্থ কবিতা।