নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি। পরাধীন দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে তাঁকে মুক্ত করার জন্যই শুধু তাঁর বিদ্রোহ নয়, তাঁর বিদ্রোহ শোষণ, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। মানুষের বিরুদ্ধে যে অন্যায় করে তার বিরুদ্ধেও তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে—
“জনগণে যারা জোঁক-সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান-সম পালে যারা জমি তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
মাটির মালিক তাঁরাই হন—
যে যত ভণ্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।
নিতি নব ছোড়া গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।
ভগবান! ভগবান।
‘দারিদ্র্য’ কবিতাটির মধ্যেও কবির বিদ্রোহ মনোভাবেরই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ কবিতায় কবি শুধু দারিদ্র্যের বর্ণনাই করেন নি, দারিদ্র্যের বন্দনাও করেছেন। দারিদ্র্যের পীড়ন কবির আত্মাকে অবদমিত করতে পারে নি বরং তাঁকে মহান করে তুলেছে। তিনি মনে করেন, দারিদ্র্যই মানুষের মধ্যে অগ্রগতির প্রেরণা দেয়। আর সেই অগ্রগামী মানুষই মানব সমাজে বরেণ্য এবং তাঁর পেছনে রয়েছে দারিদ্র্যরূপ চালিকাশক্তি। কবি অনুভব করেন সকল প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে দারিদ্র্যই তাঁর অনুপ্রেরণারূপে কাজ করে।
নজরুলকে কখনই দুঃখবাদী কবিরূপে চিহ্নিত করা যায় না। দুঃখবাদের মধ্যে যে হতাশা ও বিষণ্ণতা লীন হয়ে থাকে নজরুলের কাব্যে সাধারণভাবে এবং ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় বিশেষভাবে সকল যুগের মধ্যে কবি দুঃখের সন্ধান পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সে দুঃখ কবিকে অভিভূত করে না বরং বাস্তব জীবনকে বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ করে। দারিদ্র্যের স্পর্শে সকল রোমান্টিক সুখকল্পনা নিমেষে অন্তর্হিত হয়।
দারিদ্র্য কবিকে সুন্দরের সাধনায় বাধা দেয়, একথা ঠিক। রসপিপাসু কবির রসাস্বাদন ও রসসৃষ্টির প্রচেষ্টা দারিদ্র্যের স্পর্শে বিশুদ্ধ হয়ে পড়ে এ কথাও ঠিক। তাই তিনি দারিদ্র্যকে সম্বোধন করে বলেন—
“যুক্ত করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই— হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান।”
কিন্তু একথাও কবি উপলব্ধি করেন যে দারিদ্র্য তার মনুষ্যত্বের মহিমাকে ব্যক্ত ও প্রদীপ্ত করেছে—
“উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।”
মনুষ্যত্বের মহিমা উপলব্ধি করে দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যকে উত্তীর্ণ হওয়ার যে চেষ্টা করছে কবি তার যে বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে সংগ্রামের চেতনাই অনুভব করা যায়, দুঃখবাদ নয়। দারিদ্র্য নিত্য অভাবের কুণ্ড প্রজ্জ্বলিত রেখে যেন মৃত্যুযজ্ঞের অনুষ্ঠান করছে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সেই অনুষ্ঠান যে চলেছে আসলে তা শোষিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, দরিদ্র মানুষেরই শোষক ও ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম—
“লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি’ ফেলিতেছ টানি
ধূলিতলে।”
কিন্তু কবির দুঃখ বেদনার কথাও আলোচ্য কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। আগমনী উৎসবে মিলন ও আনন্দের যে আয়োজন তার থেকে কবি নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও বেদনা বোধ করেন। কারণ তিনি সকল বিষয়ে বঞ্চিত, কোনও আনন্দ উপলব্ধি তাঁর করা নেই। দৈনন্দিন আর্থিক অভাব তাঁকে অবিরত পীড়ন করছে। কিন্তু এই পীড়নজাত দুঃখ তাঁকে অভিভূত করতে পারে নি, শ্মশানচারী শিবের মতই নীলকণ্ঠ হয়ে তিনি ধুতুরা ফুলের বিষাক্ত রস পান করতে প্রস্তুত।
দারিদ্র্যের মুখ যে কবি অবহেলায় উপেক্ষা করতে পারেন, নিজেকে শ্মশানচারী শিবের সঙ্গে উপমিত করায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রামের যে মনোভাব প্রতিফলিত হয় নজরুলের কবি মানসে সে মনোভাব সক্রিয় থাকায় দুঃখ অনুভব করলেও দুঃখবাদী হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
Leave a comment