কবি বিষ্ণুদেব লেখা ‘দামিনী’ তার ‘স্মৃতিসত্তা ও ভবিষ্যৎ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ১৯৬০ সালে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনে এটি স্থান পায়। ভাব এবং শৈলী উভয় দিক থেকে কবিতাটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
‘দামিনী’ একটি নামবাচক কবিতা, কোন চরিত্রের নাম কবিতার নামকরণ তেমন সুলভ নয়৷ ‘বনলতা সেন’, ‘সুচেতনা’, ‘দামিনী’ এই বিরল শ্রেণির কবিতা। এখানেও কবিতাটি স্বতন্ত্র ৷ সুচেতনা কিংবা বনলতা কবি জীবনানন্দের মানস প্রতিমা। কিন্তু ‘দামিনী’ তা নয়। চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাস থেকে নেওয়া। সে চতুরঙ্গ উপন্যাসের নায়িকা। রবীন্দ্র উপন্যাসের নায়িকাকে ঘিরে কবির অনুভূতিলোক আলোড়িত হয়েছে। সে আলোড়নের ফলশ্রুতি বক্ষ্যমান কবিতা। ফলত এখানে পূর্বসুরীর সৃষ্টির অনুকরণ মাত্র হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং কবি কল্পনার রশ্মিপাতে রবীন্দ্রনাথের দামিনী এখানে এক অন্যমাত্রা পেয়েছে। বলা চলে বিষ্ণুদের হাত পড়ে রবীন্দ্রনাথের দামিনীর রূপান্তর ঘটেছে। সুতরাং এর কাব্যশৈলী আসলে ‘রূপান্তরের কাব্যশৈলী’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শৈলীবিচার করতে গেলে এই ‘রূপান্তরের দিকটি মনে রাখা দরকার।
কবিতাটি দুটি স্তবকে বিভক্ত। প্রথম স্তবকে কবি প্রেম নিবেদন দামিনীর অতৃপ্তি বোধের দিকটি উদঘাটিত করেছেন। রবীন্দ্র উপন্যাসের নায়িকা দামিনী প্রথমে করেছিল শচীশকে। কিন্তু শচীশ তাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। অথচ শচীশকে দামিণী অন্তর থেকেই চেয়েছিল কারণ তার সংস্পর্শেই দামিনীর জীবনে ঘটেছিল অমূল পরিবর্তন শচীশের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান হয়ে দামিণী শ্রীবিলাসকে বিবাহ করেছে। কিন্তু শ্রীবিলাসকে হৃদয় দিতে পারেনি। কিন্তু শ্রীনিবাস তাকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। মৃত্যুর কোলে পৌঁছে দামিনী বলেছে—’সাধ মিটল না’। এই সাধ প্রকৃত প্রেমের সাধ। এই সাধ অপূর্ণ থেকে গেছে দামিনীর জীবনে।
কবিতার প্রথম স্তবকের সূচনায় কবি বিদে ‘দামিনী’র সেই অতৃপ্ত সাধের কথা উল্লেখ করেছেন, উল্লেখিত হয়েছে অপূর্ণ সাধ পূর্ণজন্মের আকাঙ্ক্ষার কথাও :–
‘সেদিন সমুদ্র ফুলে হ’ল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায়
সেদিন দামিনী বুঝি বলেছিল-মিটিল না সাধ।
পূর্ণজন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্র মৃত্যুর সীমায়,
প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ,
সেদিন দামিনী, সমুদ্রের তীরে।
রবীন্দ্রনাথ আদর্শ কবিতার আবশ্যিক গুণ রূপে চিত্রধর্মিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এই চিত্রধর্মিতা বক্ষ্যমান কবিতার শৈলীর একটি বিশিষ্ট দিক। উপরোক্ত প্রথম স্তবকে কবি একটি অনবদ্য চিত্রকল্প উপস্থাপন করেছেন উত্তাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রেম পিপাসার্ত দামিনী। সময় তখন মাঘী পূর্ণিমার রাত্রি কবিতা মুখর ছবি—এই উক্তি যে কতদূর সত্য তা এখানে স্পষ্ট।
প্রথম স্তবকে শৈলীগত বিচারে স্থান ও কালের দ্বন্দ্বের দিকটিও বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। দ্বন্দ্বের বিন্যাসটি নির্মিত হয়েছে দুটি বাক্যে।
-
(১) সেদিন সমুদ্র ফুলে হ’ল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায়
-
(২) সেদিন দামিনী বুজি বুঝেছিল–মিটিল না সাধ।
দুটি বাক্য যথাক্রমে সরল বাক্য এবং জটিল বাক্য। প্রথম বাক্যটিতে মাঘ মাসের পূর্ণিমায় সমুদ্রের যে অপরূপ রূপতা বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যটিতে দামিনীর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছে। দুটি বাক্যের মধ্যে কোনও ভাবগত সম্বন্ধ নেই। অথচ একটি মাত্র পূর্ণচ্ছেদের মধ্যে বাক্য দুটিকে ধরা হয়েছে। আসলে আপাত বৈপরীতের মধ্যে কবি সম্বন্ধের সূত্র প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। সমুদ্রের ফুলে ওঠা আর দামিনীর ‘মিটিল না সাধ’ এই উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে দামিনীর হৃদয় বেদনাই যেন অভিব্যক্ত হয়েছে। প্রকৃতি এবং মানুষের বেদনা এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
পরবর্তী ত্রয়ী পত্তি দামিনীর আকাঙ্ক্ষার কবিভাষ্য—
“পূর্ণজন্মে চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্র মৃত্যুর সীমায়
প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ,
সেদিন দামিনী, সমুদ্রের তীরে।”
তিনটি বাক্যই সরল বাক্য। এখানে অবস্থা এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দ্বন্দ্বের দিকটি— লক্ষণীয়-দামিনী রয়েছে মৃত্যুর সীমায়। কিন্তু ক্ষোভময় জীবনের পরিবর্তে প্রকাশ করেছে পূর্ণজন্মের আকাঙ্ক্ষা। দামিনীর এই আকাঙ্ক্ষাকে কবি ব্যাখ্যা করেছেন প্রেমের সমুদ্রে পূর্ণিমার অগাথ নীলিমা খোঁজার সঙ্গে।
দ্বিতীয় স্তবকে কবি নিজের জীবনের কথা বলেছেন যে কবির কাছে প্রিয়া রূপে প্রতিভাত হয়েছে। তার জীবনের প্রত্যহিকতায় সমুদ্র তীরের দামিনী ছড়িয়ে পড়েছে। এক ঋতুর থেকে আর এক ঋতুর পূর্ণিমায় দামিনী তাকে প্রেমের উত্তাপে জাগিয়ে রাখে। কবি তাই লেখেন—
“আমার জীবনে তুমি বুঝি প্রত্যহই ঝুলন পূর্ণিমা
মাঘী বা ফাল্গুণী কিংবা বৈশাখী রাস বা কোজাগরী,”
লক্ষ্যণীয় প্রথম স্তবকে দামিনীকে একটি কালো (মাঘী পূর্ণিমায়) সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল এখানে দামিনীর বিস্তার কালে কালান্তরে। এখানে প্রথম পক্তি এবং দ্বিতীয় পঙ্ক্তি দুটিই গঠনের দিক থেকে সরল। এরপর তৃতীয় পক্তিও সরল বাক্য। এখানে অমাবস্যার রাতে কবির জীবনে দামিনীর প্রেমের বিস্তারের কথা বলা হয়েছে, পূর্ণিমার পর অমাবস্যার কথা বলায় একধরনের কালগত বৈপরীত্য যে সৃষ্টি হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। বিরহের অন্ধকারেও কবিকে দামিনী সেন জাগিয়ে রাখে। তিনি দামিনীর প্রেমের সমুদ্রের ডুব দিতে চায়। এখানে আধুনিক কবির অন্তরে সংগুপ্ত লিবিত চেতনাকে যেন ছোঁয়া যায়। সমুদ্র যেমন রত্ন ভান্ডারে নারীদেহ তেমনি রত্নের ভাণ্ডার। সেই রত্ন যেন সংগ্রহ করতে চান কবি দামিনীর দেহ সমুদ্রে ডুব দিয়ে। এরপরেই কবি যখন বলেন—
“দামিনী, সমুদ্রে দীপ্ত তোমার শরীরে,
তোমার সমুদ্রে আর শরীরে তীরে।।”
তখন কবির এই অতৃপ্ত প্রেম পিপাসা, বাসনাকাঙ্ক্ষার দিকটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
সার্বিক বিশ্লেষণে স্পষ্ট বোঝা যায় বক্ষ্যমান কবিতায় কবি রবীন্দ্র উপন্যাসের নায়িকা দামিনীর অতৃপ্ত প্রেমাকাঙ্ক্ষাকে কাব্যভাত করার জন্য কলম ধরেননি। তিনি এখানে দামিনীকে ঘিরে স্বীয় প্রেম উপলব্ধিকে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। সুতরাং এই কবিতায় মূল শৈলী হল রূপান্তরের কাব্যশৈলী। এখানে দামিনী শেষ পর্যন্ত প্রেম বঞ্চিতা এক নারী মাত্র নয়। সে কবির কামনা-বাসনার এক মূর্ত প্রতীক। এই রূপান্তরের উপরেই কবিতাটি শৈলী গত ভিত্তি দণ্ডায়মান।
বক্ষ্যমান কবিতায় শব্দের ব্যবহারের দিকটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যেমন নিম্নোক্ত পঙ্ক্তি—
“আমারও মেটে না সাধ তোমার সমুদ্রে যেন মরি
বেঁছে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিবস-যামিনী।
এখানে ‘তোমার সমুদ্র’ শব্দ বন্ধটি লক্ষণীয়। হওয়া উচিত ছিল ‘তুমি সমুদ্র’ কিন্তু কবি লিখলেন ‘তোমার সমুদ্র’ শব্দের এই সচেতন পরিবর্তনের ফলে এসেছে গভীরতর ব্যঞ্জনার স্পর্শ। সমুদ্রের মধ্যে যে ব্যপ্তি এবং গভীরতা রয়েছে দামিনীর প্রেমে রয়েছে সেই ব্যাপ্তি এবং গভীরতা আবার কখনো কখনো শব্দের সঙ্গে শব্দের সংযোগ বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা কবি রচনা করেছেন—
“দামনী, সমুদ্রে দীপ্র তোমার শরীরে,
তোমার সমুদ্র আর শরীরের তীরে।।”
এখানে প্রথম পঙ্ক্তিতে কবি দামিনীকে সম্বোধন করে বলেছেন তার শরীর সমুদ্র দীপ্র কিন্তু পরবর্তী পঙ্ক্তিতে তোমার সমুদ্র বলে দামিনী এবং সমুদ্রের মধ্যে অভেদ কল্পনা করেছেন। এর ফলে এক বৈপরীত্যের ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সমুদ্র, পূর্ণিমা এবং এই দুটি শব্দ এখানে বহুমাত্রিক-অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কখনও সমুদ্র শব্দটি দ্বারা প্রাকৃতিক সমুদ্রকে বোঝানো হয়েছে আবার সমুদ্র বলতে কখনও দামিনীর প্রেমের ইঙ্গিত করা হয়েছে। পূর্ণিমা বলতে মাঘী পূর্ণিমাকে বোঝানো হয়েছে আবার যখন বলেন—
আমার জীবনে তুমি বুঝি প্রত্যহই ঝুলন পূর্ণিমা।
তখন পূর্ণিমা শব্দটির দ্বারা ঝুলনের অনুষঙ্গে এসেছে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের অবক্ষয়। একই শব্দের এই একাধিক অর্থে ব্যবহারের প্রবণতা বক্ষ্যমান কবিতার শৈলীর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ।
লক্ষ্যণীয় বক্ষ্যমান কবিতাটি মূলত তৎসম শব্দে গঠিত। যেমন সমুদ্র, পূর্ণিমা, পূর্ণচন্দ্ৰ, নীলিমা। প্রেম প্রভৃতি আবেগতীরতা, জীবনে অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষা প্রাশে এখানে শব্দগুলি সহায়ক হয়েছে বলেই মনে হয়। দেশজ শব্দের ব্যবহারে ও অবশ্য দু-একটি ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন ‘ফের’ কবি এখানে কখনও বিশেষ্য পদের পূর্বে দুটি বিশ্লেষণ বসিয়েছেন। যেমন ‘উন্মুখ মাঘী পূর্ণিমা’ । আবার কখনও বিশেষণ বিশেষ্যর পরে বসেছে। যেমন ‘নিলীমা অগাধ, অমবস্যা নিরাকার প্রভৃতি।
দামিনী কবিতার ছন্দের দিকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কবিতাটি অক্ষরবৃত্তে রচিত হয়েছে।
পরিশেষে শৈলীগত বিচারে বল যায় দামিনী কবিতার গড়ন স্থাপত্যধর্মী। এখানে সংগীতময়তা নেই। পরিমাণের চিত্রগুণ অবশ্য রয়েছে। তবে এর মূল আকর্ষণ হল শব্দের ব্যবহার। শব্দের পর শব্দ বেঁচে কবি কবিতাটির কায়া নির্মাণ করেছেন। এই নির্মাণে কোনা ফাঁক নেই। বলা চলে শব্দের কুশল ব্যবহারই কবিতাটিকে স্থাপত্যধর্মীতা প্রদান করেছে।
Leave a comment