কাব্যের সংজ্ঞা বিষয়ে কবিদের মধ্যে নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলেও একথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’, অর্থাৎ কাব্য হল রসাত্মক বাক্য। মনের মধ্যে যে ভাব অন্তঃসলীলা রূপে বয়ে চলে তাকে ভাষার মধ্যে সঞ্চারিত করাই হল কবিতার উদ্দেশ্য। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন— ‘যে অন্তর্নিহিত শক্তি দ্বারা কবিতার ভাব ও ভাষার সম্পূর্ণ একীকরণ সম্পন্ন হয় তাহাই কবিতার আত্মা’।
কবিতার শৈলী হল সেই অন্তর্নিহিত শক্তি যার দ্বারা কবিরা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠেন। আর শৈলীচর্চার উদ্দেশ্য হল সেই পদ্ধতিটিকে বুঝে নেওয়া যার দ্বারা কবি কবিতায় সার্বজনীন রসাবেদন সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছেন।
বিষ্ণু দে-র দামিনী কবিতা এক নবজীবনবোধকে তুলে ধরে, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেনের’ মতো দামিনী কোনো মৌলিক নারী নন, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্বাস্তবতামূলক উপন্যাস চতুরঙ্গের এক উচ্ছল চরিত্র মাত্র। চতুরঙ্গের দামিনীর মনে অতৃপ্ত এসেছিল ইস্পিতকে না পাওয়ার বেদনা থেকে। শচীশকে কামনা করলেও শ্রীবিলাসকে গ্রহণ করতে সে বাধ্য হয়েছে ; বলেওছে যে ‘সাধ মিটল না’ । বিষ্ণু দে ঠিক এইখান থেকেই দামিনীকে নতুন এক পথের সন্ধানী করে তুলেছে। হিন্দুর পুনর্জন্মবাদকে কবি কাজে লাগিয়ে দামিনীর অভিলাসের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আশাবাদকে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো রবীন্দ্রনাথের ভাবের বেড়াজাল ছিন্ন করার প্রত্যয় নিয়ে যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন বিষ্ণু দে তাঁদের অন্যতম হলেও তাঁর এই কবিতাতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
কবিতার প্রথম স্তবকে দামিনী হাজির হয়েছে বুকে একরাশ নিরাশার বার্তা বয়ে। দ্বিতীয় স্তবকে কবি নিজের মধ্যে দামিনীকে খুঁজতে চেয়েছেন, যে তার জীবনে প্রত্যই ঝুলন পূর্ণিমার আনন্দ আনে। মানুষ সর্বদাই তার প্রিয়তমকে খোজে যার মধ্যে দুদন্ড শাস্তির আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনানন্দ যেমন বলেন—
‘আমার দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’
আর কবি বিষ্ণু দে দামিনীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল সেই শান্তির আশ্রয়। তাই বলেন—
‘আমার জীবনে তুমি প্রায় বুঝি প্রত্যহই ঝুলন পূর্ণিমা’
প্রথম স্তবকে দামিনী প্রেমের সমুদ্রে পূর্ণিমার নীলিমা খুঁজেছে আর কবির মনে সেই দামিনী সর্বদাই আলোড়ন তুলেছে। তা শুধু পূর্ণিমায় নয়। ঝুলন পূর্ণিমা, মাঘী বা ফাল্গুনী কিংবা বৈশাখী রাশ কোজাগরী পূর্ণিমাতেও তার অস্তিত্ব কবির মনে জাগ্রত। আবার শুধু পূর্ণিমা কেন অমাবস্যাতেও কবি অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেন না দামিনীকে। এখানে পূর্ণিমার পরই অমাবস্যা এসে একটা বৈপরীত্য সংঘটিত করেছে। যা শুধু কবির মনে দামিনীর প্রেমের গভীরতাকে চিনিয়ে দেয় । পূর্ণিমা শব্দটি বহুল ব্যবহারে এটা বুঝতে পারা যায় প্রেম ও পূর্ণিমা দুটি সমার্থক শব্দ । আবার অমাবস্যা আসে তখনই যখন প্রেমের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। অর্থাৎ দামিনী শচীশের প্রেম কবিকে একদিকে নাড়া দিয়েছেন, অপরদিকে তাদের বিচ্ছেদ জনিত অতৃপ্তিও কবিকে আলোড়িত করেছে। প্রেমের সম্পূর্ণতা কি বিচ্ছেদ ? কবি দুটোকেই গ্রহণ করেছেন ; প্রেম সর্বদাই পুনর্জন্ম চায় দামিনীও চেয়েছে। কবি বলেছেন—
‘পুনর্জন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্রে মৃত্যুর সীমায়’
পুনর্জন্ম একদিকে বলা যেতে পারে মৃত্যুর মাধ্যমে পুনর্জন্ম আবার অন্য দিকে মৃত্যুর পর নবজন্মে আবার এই ধরাতলে ফিরে আসার বাসনা। কিন্তু ‘মিটিল না সাধ’ এই কথাটিই বোধ হয় সার্বিক সত্য; কারণ ‘প্রেম ও প্রেমের ফল দু-রাস্তায় চলে’।
এইভাবে অসাধারণ অর্থপূর্ণ সাজ সজ্জার মাধ্যমে প্রেম সম্পর্কে দ্বিধা দ্বন্দ্ব প্রকাশিত করেছেন এবং প্রেমের দোলচলতা জনিত স্পন্দন কবি নিজের মনে সঞ্চারিত করেছেন। বিপ্লব চক্রবর্তী লিখেছেন— ‘দামিনীর শরীর সমুদ্র, শরীরের মতো দীর্ঘবহ-আন্দোলিত দিন। দামিনী সমুদ্রে কবির বেঁচে মরার সাধ তার জীবনাকাঙ্ক্ষারই অন্যরূপ। এ দামিনী নঞর্থক নয়, সার্থক আশা নিরাশায় দোলায় দোলা বহমান জীবনের দোলা, সেইজন্য সমুদ্রে শোভমান দামিনীর শরীর। আবার শরীরে, তীরে কবির অবস্থান। বৈপারীত্যের শব্দ সংযোগে রূপমূর্তি নির্মাণের শৈলী এখানে চিহ্নিত।
শৈলীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবে ছন্দ অলংকারকে অস্বীকার করা যায় না। বিষ্ণু দে এই কবিতায় ছন্দ ও অলংকারের সুষম বিন্যাস ঘটিয়েছেন।
অলংকার নির্ণয়েও কবির চমৎকার দক্ষতার পরিচয় পাই, রূপক, বাচ্যোৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অর্থালংকারকে তিনি আলোচ্য কবিতায় উপস্থাপিত করেছে।
-
বাচ্যোৎপ্রেক্ষা : ‘আমার জীবনে তুমি প্রায় বুঝি প্রত্যেহই ঝুলন পূর্ণিমা’
-
রূপক : ‘প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ’ ‘পুনর্জন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্রে মৃত্যুর সীমার’
কবিতায় কবিরা নানা ছবির মালা গাঁথেন। বস্তুত কবিতা ও চিত্রের মিল হল উভয়ের আট এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। কবিতাতেও কবিরা চিত্রকল্প কল্পনা করেন, সৃষ্টির উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য আলোচ্য কবিতায় চিত্রকল্প অনেকটাই বিষয়মুখী।
‘সেদিন সমুদ্র ফুলে ফুলে হ’ল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমা
সেদিন দামিনী বুঝি বলেছিল মিটিল না সাধ
পুনর্জন্ম চেয়েছিল জীবনের পূর্ণচন্দ্রে মৃত্যুর সীমায়,
প্রেমের সমুদ্রে ফের খুঁজেছিল পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ,
সেদিন দামিনী সমুদ্রের তীরে।
দামিনী কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখতে পাই একপ্রকার সংশয়কে যা দামিনীর মধ্যে আছে ‘বুঝি’ শব্দ সেই সংশয়কেই প্রকাশ করতে চায়। কবিতায় মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেও একপ্রকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আভাস আমরা দেখতে পাই। শব্দ বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ্য বিশেষণের ক্রম পালটে যাচ্ছে যেমন কখনও মাঘী পূর্ণিমা আবার কখনও নিলীমা অগাধ। একদিকে দেশজ অন্যদিকে তৎসম উভয়শব্দকে সুন্দরভাবে কবি উপস্থাপন করেছেন। যেমন—একদিকে পূর্ণিমা, সমুদ্র অন্যদিকে ফের, সাধ প্রভৃতি। আসলে দামিনীর প্রেমে মুগ্ধ কবি ; জীবনে মরণে প্রতিক্ষণে তার দামামার মতো হৃদপিণ্ডের তালকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন। কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিয়েছেন দামিনীর আশাহীনতা ; আর কবিরও আশাহীনতা। তাই কবি বলেন—
‘আমারও মেটেনা সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি’
এর সঙ্গে পরজন্মের প্রসঙ্গ ; দামিনী পুনর্জন্ম চেয়েছে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে নিবৃত্ত করার জন্য। এই প্রসঙ্গটাই কবিতাকে যেন অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
Leave a comment