জীবনচরিতের মধ্যে কবিকে পাওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির সুক্ষ্ম জীবনবোধের অন্বেষণ করতে হয় তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই। তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি বা বিচ্ছিন্ন কোনো কবিতা কিংবা কবিতার পক্তির মধ্য থেকে কবির স্বরূপ আবিষ্কারের চেষ্টা যথার্থ নয়। কবির সার্বিক সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়েই পাওয়া যায় তাঁর বিচিত্র ব্যক্তিগত ও সামাজিক টানা পোড়েন এবং দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার ইতিহাস। এক্ষেত্রে কবি বিষ্ণু দে-র একটি বিশেষ কবিতার (‘দামিনী’) বিচ্ছিন্ন পত্তির মধ্য থেকে কবির জীবনবোধের কোনো সার্বিক পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। তবু বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো এই বিচ্ছিন্ন পভুক্তিতে উচ্চারিত বাসনার মধ্যে কবি বিষ্ণু দে-র কবি স্বভাবের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।

বিষ্ণু দে-র কবি হিসাবে আবির্ভাব তিনের দশকে। অর্থাৎ তিনি বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ দাশের সমকালীন। আধুনিক কবিতার এই পর্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অস্থিরতা, এক যুদ্ধের স্মৃতি—আর এক যুদ্ধের পূর্বাভাস, ভারত তথা বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাশে এক অনিশ্চয়তার কালো ছায়া বিস্তৃত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভূমি চূর্ণ হয়ে গেছে, চতুর্দিকে নৈরাশ্যের হাহাকার ও হতাশার চোরাবালি। এলিয়টের প্রজ্ঞা দিয়ে এ ক্ষত পূরণ করা অসম্ভব, ষোড়শ শতকে ভক্তিমার্গও বিংশ শতকে অচল। ফলে আধুনিক কবিদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে এক তীব্র শূন্যতাবোধ, রক্তক্ষয়ী অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সীমাহীন অসহায়তা। প্রত্যেক কবিই প্রায় বিচ্ছিন্ন একাকীত্বের বোধে পীড়িত হয়ে পৃথিবী ও জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ এবং কখনও পলায়ন প্রবণ, কখনও-বা অন্ধকারময় মৃত্যুচেতনায় আবিষ্ট।

যুগ ও জীবনের এই সার্বিক অবক্ষয়ের মধ্যে রাবীন্দ্রিক প্রেম ও সৌন্দর্যবোধের কিংবা তাঁর আনন্দময় আস্তিক্যধর্মের অপ্রাসঙ্গিতাই প্রথমে স্পষ্ট হয়ে উঠল আধুনিক কবিদের কাছে। সেই সঙ্গে কাব্যরচনায় রাবীন্দ্রিক প্রভাবের আবর্ত থেকে বেরোবার এক তীব্র আগ্রহও কার্যকরী ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়ে বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিতে জীবনের বিকারকে দেখে ও অবক্ষয়প্রাপ্ত জীবনের তীব্র হলাহল পান করে আধুনিক কবিরা গড়ে তুলতে চাইলেন এক ‘না’-এর জগৎ। বিষ্ণু দে এই আধুনিক কবিকুলের অন্যতম হলেও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শনের বিপুল জ্ঞান, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিকাশের দ্বান্দ্বিক ইতিহাস-বোধ এবং মার্কসীয় জীবন-চেতনায় বিশ্বাস এই নেতিবাদের জগৎ থেকে বিষ্ণু দে-কে এক স্বতন্ত্র জগৎ রচনায় প্রবুদ্ধ করেছে। দীপ্তি ত্রিপাঠীর মন্তব্য অনুযায়ী—‘আধুনিক কাব্যের ক্লান্তি জিজ্ঞাসা, সংশয়, বিতৃয়া, নৈরাশ্য ও নির্বেদের বিশৃঙ্খল বাষ্পপুঞ্জ থেকে তিনি সৃষ্টি করেছেন বিশ্বাসের ধ্রুবলোক।…..বিষ্ণু দে-র অন্বিষ্ট একক সাধনার পথে মেলে না–মেলে সচেতন সমবায়ের পথে।’

এই ‘বিশ্বাসের ধ্রুবলোকে’ অধিষ্ঠিত থেকেই বিষ্ণু দে যুগগত বিকার ও স্ববিরোধিতাকে প্রত্যক্ষ করেন, কিন্তু জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে হতাশার কুম্ভীপাকে অস্তিত্বের বিনাশকে স্বীকার করেন না। বরং এক দ্বান্দ্বিক বিকাশের চলমানতাকে স্বীকার করে নিয়েই তিনি এই দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ মধুরে-গরলে মিশ্রিত জীবনকে ভালোবাসেন। চোরাবালির বন্ধ্যাবুকে দাঁড়িয়েও তিনি প্রিয়তম পুরুষকারের আসঙ্গ কামনা করেন তীব্র আবেগে—

“হে প্রিয় আমার প্রিয়তম মোর, 

অযোজন কাঁপে কামনার ঘোর।

কোথায় পুরুষকার?

অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?’

এই অপরিমেয় জীবন-সম্ভোগের কামনাতেই বিষ্ণু দে স্বতন্ত্র। বিষ্ণু দের অন্বিষ্ট জীবন—সহাস্য জীবন। শত প্রতিকূলতা ও বিরুদ্ধতার মধ্যেও তাঁর অন্বিষ্ট জীবনে বাঁচার আনন্দ—

‘আমারও অন্বিষ্ট তাই

সূর্যাস্তে ও সূর্যোদয়ে ইন্দ্রধনু ভেঙে দিই জীবনে ছড়াই 

হে সুন্দর বাঁচার বিস্ময়ে বিষাদে সম্ভ্রমে জীবনে আকাশ

অবকাশ বাঁচার আনন্দ চাই।’

জীবনকে যে সত্যিই জানতে চায়, তার তো সত্যিই শান্তি নেই। তার পথ সত্যিই তো বন্ধুর। এই ঊষর বন্ধুর পথ বেয়ে রক্তাক্ত পদক্ষেপে চলাই তো জীবন। বিষ্ণু দে তাই বলেন—

‘তোমাকে জেনেছে যে শান্তি নেই

জীবনে তার আর……?’

জীবনের প্রতি এই পরম মমতায়—এই সুগভীর জীবনপ্রেমই বিন্নু দে-কে রবীন্দ্রনাথের নিকটবর্তী করে। রবীন্দ্রনাথের কৈশোরে উচ্চারিত সেই বাণী ‘মানুষের মন চায় মানুষেরই মন।’ বিন্নু দে-কে স্বীকার করতে হল রবীন্দ্রনাথের আনন্দময় বিশ্ববীক্ষার মহত্ত্ব—

‘কবিকাহিনী-ভগ্নহৃদয়ের সময় থেকেই যে সংকটবোধ ও অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথকে ব্যাকুল করেছিল, তাকে তিনি নিজেই পুরুষার্থের বিন্যাসে বেঁধেছিলেন অল্পবয়সেই…..। এই কবিত্বের তাড়নাতেই তাঁর শাস্তি ছিল না কোনো দিন……। কারণ ঐ সংকটের সমাধান ছিল নিত্যকরণীয়র ও ক্রমান্বয়িক…..। কিন্তু ঐ দ্বন্দ্বময়তাকে তিনি কয়েকটি পুরুষার্থ বা মূল্যবোধের আবেগে বেঁধেছিলেন বলেই তাঁর রচনা ও কর্মবৈচিত্র্য প্রায় অন্তহীন।’ (‘রবীন্দ্র শতবার্ষিকী’—বিষ্ণু দে)

তাছাড়া বিচিত্র প্রতিকূলতা ও দ্বন্দ্বমুখর পথ ধরেই রবীন্দ্রনাথ চলেছেন স্বরচিত এক সমাধানের দিকে এবং সেই নিয়ত চলা জীবনরসের মধুর-তিক্ত-কথায় স্বাদ গ্রহণ করতে করতেই। আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন সুন্দর। প্রথম জীবনে তিনি বলেন—’মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ জীবনের অস্তিমে এসেও তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়—এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি-‘জীবনে চলার পথে অজস্র ‘কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি’-তে যন্ত্রণার্ত হয়েও তাঁর অনুভব জীবনের সত্যকে লাভ করার জন্যই এই তামস-তপস্যা, মৃত্যুকে তাই তিনি জীবনের সত্যান্বেষণের শেষ মূল্য হিসাবেই গ্রহণ করেন—

‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন 

সত্যের দারুণমূল্য লাভ করিবারে

মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।

বিষ্ণু দে তাই পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেন দ্বন্দ্বময় প্রতিকূল পথে চলার মন্ত্রস্বরূপেই—

“জঙ্গম সূর্যকে জানি আমাদের জঙ্গী প্রতিদিনে

অবিচ্ছিন্ন মাসে মাসে বর্ষে বর্ষে যুগ যুগ ব্যেপে 

প্রতিটি ঊষায় রাত্রে মধ্যাহ্নের বটে দগ্ধতূণে

গলাপিচে বৈশাখীর ভবিষ্যতে ঝড়ে মেতে ক্ষেপে

প্রতিটি সূর্যাস্তে আর সূর্যোদয়ে চৈতালী নিদাঘে

আষাঢ়ে শ্রাবণে আর আশ্বিনে অঘ্রাণে হিম মাঠে।

রাবীন্দ্রিক এই মন্ত্রেই কবি বিষ্ণু দে কখনো জীবনের পিপাসা হারান না এবং তাঁর জীবনদৃষ্টি থেকে কখনো প্রেম তার মাধুর্য হারায় না। এই কারণেই বিষ্ণু দে তাঁর নিজস্ব জীবনদৃষ্টির দিশারী হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রজীবনদৃষ্টিকে এবং সেই বিশেষ জীবনবোধের প্রতীকরূপে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নায়িকা দামিনীকে।

‘চতুরঙ্গে’র দামিনী জীবনের পূর্ণপাত্রের সোচ্চার দাবীতে উজ্জ্বল। কোনো তত্ত্ব-দর্শনের মায়া-চশমায় জীবনকে দেখতে বা জীবনকে প্রবঞ্চিত করতে সে স্বীকৃত নয়—’সে জীবন রসের রসিক….সে সন্ন্যাসীকে ঘরে স্থান দিতে নারাজ, সে উত্তুরে হাওয়াকে সিকি পয়সা খাজনা দিবে না পণ করিয়া বসিয়াছে।” এই অবিমিশ্র জীবন-তৃয়াতেই দামিনী লীলানন্দের অপ্রাকৃত ভক্তি ভাবোল্লাসকে উদ্ধতভাবে উপেক্ষা ও অস্বীকার করেছে। জীবনের পূর্ণপাত্রে অধর স্থাপনের বাসনায় সে শচীশকে বারবার লীলানন্দের আবর্ত্ত থেকে ছিঁড়ে আনতে চেয়েছে মাটির সীমায়। বারবার শচীশের কাছে প্রতিহত হয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রীবিলাসের সঙ্গেই সে জীবন রসের পাত্র পূর্ণ করার ব্রত গ্রহণ করেছে। কিন্তু জীবনের পূর্ণতার জ্যোৎস্নায় যখন তাদের দাম্পত্য-আকাশ প্লাবিত, তখনই তার অস্তিম লগ্ন ঘনিয়েছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ভরা জ্যোৎস্নায় সে শ্রীবিলাসের কাছে অপরিমেয় জীবনতৃয়া ব্যক্ত করেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে— ‘যেদিন মাঘের পূর্ণিমা ফাল্গুনে পড়িল, জোয়ারে ভরা অশ্রুর বেদনায় সমস্ত সমুদ্র ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, সেদিন দামিনী আমার পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই।’

দামিনীর এই জীবনতৃষ্ট্বাই বিষ্ণু দের কাছে সদর্থক জীবন ভাবনার প্রতীকরূপে ধরা পড়েছে। তাই কবি নিজেই উল্লেখ করেছেন—

‘আমারও মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি 

বেঁচে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিবস-যামিনী

দামিনী, সমুদ্রে দ্বীপ্র তোমার শরীরে।

দ্বন্দ্বময় জীবনে থেকেও নৈরাশ্যের মৃত্যু না চেয়ে জীবনের পূর্ণপাত্রে অধর স্থাপনের মধুর বাসনাতেই বিষ্ণু দের বিশিষ্টতা। আর এই জীবনতৃয়ার তীব্রতাতেই দামিনীর সঙ্গে কবির জীবন বোধের সাদৃশ্য সুস্পষ্ট হয়েছে ‘দামিনী’ কবিতায়।