বাংলা আধুনিক কবিগণের মধ্যে যে ক’জন কবি কবিতার শিল্পপ্রকরণ তথা আঙ্গিক বিষয়ে অতি সচেতন, তাদের মধ্যে বিষ্ণু দে অন্যতম। স্বদেশীয় সাহিত্য পুরাণের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সাহিত্য-ইতিহাস- পুরাণের গভীর জ্ঞান বিষ্ণু দে-র কবিপ্রজ্ঞা নির্মাণ করেছিল। ফলে কাব্যবিষয়-ভাবনার পাশাপাশি, সেই বিষয়কে ভাষারূপে প্রকাশ করার জন্য কবিতার কায়ানির্মাণেও তিনি ছিলেন সতর্ক এবং অব্যর্থতার সন্ধানী। শব্দ বিন্যাসে, বাক্যমালা রচনায়, উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণের অভিনবত্বে বিষ্ণু দে যে কতখানি সচেতন, তা তাঁর কবিতার পাঠক মাত্রই জানেন। আলোচ্য ‘দামিনী’ কবিতাতেও সেই সচেতনতার ছাপ অস্পষ্ট নয়।

এজরা পাউণ্ড কবিতার তিনটি ধর্মের কথা উল্লেখ করেছিলেন— melopeia (মন্ত্রধর্ম), Phanopeia (কথ্যধর্ম) এবং Logopeia (গীতধর্ম)।

বিষ্ণু দে-র প্রথম পর্বের করিতায় লক্ষ্য করা যায় এই মন্ত্রধর্মিতা, যেমন—

‘এ-আকাশ মুছে দাও, অন্ধকারে রাত্রি লেপে দাও,

জ্যোৎস্না ডুবিয়ে দাও অনিদ্রার ঘন কালিমায়।’

কিন্তু এই মন্ত্রধর্মিতার সঙ্গেই প্রথমাবধি তাঁর কবিতায় মিশে থেকেছে অন্তলীন এক গীতিধর্ম। তবে ‘চোরাবালি’ পর্ব থেকে কথ্যভঙ্গির সাবলীল শিল্পিত মিশ্রণ তাঁর কবিতাকে অসামান্যতা দিতে শুরু করেছে। ‘বেকার বিহঙ্গ’ কবিতায় দেখি সেই কথ্য ভঙ্গির অসাধারণ বিন্যাস—

‘কৈশোরে ছিল ধর্মঘটের শখ,

যৌবনে নয় মাস্টার কেরাণীও, 

বাস্তুঘুগুরই অন্নধ্বংস সার।

মুরব্বি নেই, গ্রাম্য সে উমেদার।

বিষ্ণু দে-র কাব্যকায়া-নির্মাণে আর এক বিশেষত্ব দেশি-বিদেশী প্রসঙ্গের অবতারণা। মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী হলেও কবিতাকে সাধারণবোধ্য গণমুখী করে তোলার চেষ্টা তিনি করেন নি। তাঁর কবিতা কৃষক-শ্রমিকের শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ারও নয় কখনই—অন্তত তেমন কোনো দাবী কবির ছিল না। তাঁর কবিতা সূক্ষ্মচারী এবং বিষয়ের উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় গূঢ় যে কোনো প্রসঙ্গ উপস্থাপনে তিনি নির্দ্বিধ। ফলে কবির মতো পাঠককেও হয়ে উঠতে হয় সেইসব প্রসঙ্গের সঙ্গে সুপরিচিত। ওফেলিয়া, ক্রেসিডা, ট্রয়লাস, যযাতি, নচিকেতা ইত্যাদি প্রসঙ্গের সঙ্গে পূর্বপরিচয় ব্যতীত পাঠকের বিষু দে-র কবিতার মর্মগ্রহণ অসম্ভব।

আধুনিক কবি হিসাবে রবীন্দ্র-বলয় থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাঁরও ছিল। রবীন্দ্র-ভাব-ভাষার অক্ষম অনুসরণ বা শূন্যগর্ভ চর্বিতচর্বনে তাঁর বিরাগ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববীক্ষার বিশালতা তাঁর মনে শ্রদ্ধার আসনেই সংস্থাপিত ছিল। রাবীন্দ্রিক অতিরোমান্টিকতাকে তিনি প্রথম দিকে ব্যঙ্গ করেছেন সমকালের সঙ্গে সেই রোমান্টিক ভাবনার বৈসাদৃশ্যকে প্রকট করার জন্য—

‘বাসের একী শিংভাঙা গোঁ।

যন্ত্রের এই খাম্ খেয়াল :

এদিকে আর পঁচিশ মিনিট—

ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গমোর!’

—কিন্তু পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথকে বিষ্ণু দে আরো গভীর ও অন্তরতররূপে গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনবেদ থেকে বিষ্ণু দে-র জীবনপ্রত্যয়ের মৌলিক পার্থক্য থাকলেও বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথকে জেনেছিলেন ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটেই। তাই রবীন্দ্রনাথের জীবনঅন্বেষা ও মনুষ্যত্বের প্রতি আমৃত্যু অগাধ বিশ্বাস বিষ্ণু দেকে বিস্মিত করেছে এবং শ্রদ্ধাশীল করেছে। ‘দামিনী’ কবিতার রচনার প্রেক্ষাপটে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস পাঠে নিবিড় অনুভূতি, যেখানে দামিনী চরিত্রটির তীব্র জীবন পিপাসাকেই তিনি দেখেছেন রবীন্দ্রনাথের অক্লান্ত জীবন প্রেমের প্রতীক হিসাবে। দামিনীর এই প্রেমের আশ্চর্য উৎসারের মধ্যেই কবি নিজ জীবন অন্বেষারও সমর্থন পেয়েছেন। ফলে কবিতাটির কায়াগঠনে আবশ্যিকভাবে এসেছে, দামিনী। রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসৃষ্ট চরিত্র দামিনী তাই আলোচ্য কবিতার আশ্রয় বা আলম্বন। বিষ্ণু দে-র স্বসৃষ্ট শিল্পরীতি অনুযায়ী দামিনী জীবনতৃষ্ট্বার এক অপূর্ব প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে ‘দামিনী’ কবিতায়। তাই দামিনী চরিত্রের পূর্বপাঠ ছাড়া পাঠকের পক্ষে এই কবিতার মর্মগ্রহণ অসম্ভব।

‘দামিনী’ কবিতায় বিষ্ণু দে তাঁর পুরোনো রীতি অনুযায়ীই রবীন্দ্রসাহিত্যকে প্রায় উদ্ধৃত করেছেন প্রসঙ্গটিকে সুনির্দিষ্ট করে তুলতেই। তবে এক্ষেত্রে স্বভাবতই কোনো কবিতার পঙক্তি নয়, ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের বাক্যকেই এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে। উপন্যাসে আছে— ‘যেদিন মাঘের পূর্ণিমা ফাল্গুনে পড়িল, জোয়ারে ভরা অশ্রুর বেদনায় সমস্ত সমুদ্র ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, সেদিন দামিনী আমার পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই।’

আর ‘দামিনী’ কবিতায় প্রায় এই অংশটিরই পুনর্গঠিত রূপ— 

‘সেদিন সমুদ্র ফুলে ফুলে হল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায় 

সেদিন দামিনী বুঝে বলেছিল – মিটিল না সাধ’

বক্তব্যের কায়াগঠনে বিষ্ণু দে অত্যন্ত সচেতন। ‘চতুরঙ্গে’র সূত্রটুকু স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিয়ে অতঃপর পৌঁছেছেন স্বীয় জীবন বোধের ব্যাখ্যানে। আধুনিক মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টি প্রসঙ্গ এবং জীবন দর্শন বিষয়ক ভাবনা প্রকাশের প্রয়োজনের সম্ভবত অনিবার্যভাবে কবিতায় এসেছে মিশ্রকলাবৃত্তের ধীর লয় ও সুগম্ভীর মূর্ছনা। অর্থাৎ স্পষ্টভাবেই এজরা পাউণ্ডের উল্লেখ-সূত্রে কবিতাটি Logopeia বা সংগীতধর্ম বিশিষ্ট।

মিশ্রকলাবৃত্তের পয়ার ও মহাপয়ার কবিতার বিন্যাসে কিছু বৈচিত্র্য এনেছে। তবে এটিও নিছক আরোপিত শিল্প কৌশল নয়। তরঙ্গিত জীবনের দিবস যামিনী যেমন সমদৈর্ঘ্যে, সর্বদা নির্দিষ্ট জীবনের সেই বাহাবিষমতার মধ্যেই নিহিত থাকে কোনো গূঢ় সংগতি, তেমনি কবিতাটিতেও সেই জীবন তরঙ্গের স্বরূপকে ধরতে কখনো ৮+৮+৬=২২ মাত্রার চরণ, কখনো ৮+১০=১৮ মাত্রার চরণ, কখনো বা ৮+৬=১৪ মাত্রার চরণ বিন্যস্ত। লক্ষণীয়—

‘সেদিন সমুদ্র ফুলে/ফু’লে হল উন্মুখর/মাঘী পূর্ণিমায়’

‘এমন কি অমাবস্যা/নিরাকার তোমারই প্রতিমা’ 

‘দামিনী সমুদ্রে দ্বীপ/তোমার শরীরে’

আবার জীবনরসপিপাসু দামিনীর অপরিতৃপ্ত অসম্পূর্ণতাকে ধরতে ইচ্ছাকৃতভাবেই–বরং বলা ভাল অত্যন্ত শিল্পসচেতন ভাবেই কবি পয়ারের গঠনকে ভেঙে এবং অপূর্ণ আকার দিয়েছেন, যেমন—

‘সেদিন দামিনী,/ সমুদ্রের তীরে

কবিতাটি সংক্ষিপ্ত—মাত্র এগারো পঙ্ক্তিতে বিন্যস্ত। এই বিন্যাসের মধ্যেও সুচিন্তিত শিল্প ভাবনা বর্তমান। প্রথম পাঁচ পক্তির স্তবকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট ‘দামিনী’ চরিত্রের সূত্রটিকে ধরিয়ে দিয়েছেন কবি। পরবর্তী মাত্র তিন পক্তির স্তবকে এই জীবন পিপাসার প্রতীকী প্রতিমাটি কবিজীবনে কতখানি মাধুর্য-আলোক বিস্তারী তার ইঙ্গিত। কবি জীবনে দামিনী যেন ঝুলন, কোজাগরী, বৈশাখী, রাস বা ফাল্গুনী পূর্ণিমার মতোই মধুর অনুভূতি সঞ্চারক। সর্বশেষ তিন পক্তির স্তবকে কবির নিজস্ব জীবনবোধটি প্রকাশিত – আমারও মেটে না সাধ’ এখানেই দামিনীর সঙ্গে নিজেকে নিঃশেষে অন্বিত করে দেখেছেন কবি বিষ্ণু দে। কবিতাটির সংক্ষিপ্ত সংহত গঠন ও সুচিন্তিত স্তবকবিন্যাস উচ্চঅঙ্গের শিল্পকৃতির নিদর্শন রূপেই চিহ্নিত হবার যোগ্য।