দাঁতাত (Detente) একটি ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হল উত্তেজনা প্রশমন (relaxation of tension)। ১৯৭০-এর দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক ইতিহাসে এই পর্বটি দাঁতাত নামে পরিচিত। অর্থাৎ পারস্পরিক বােঝাপড়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুপরিকল্পিত নীতি হল দাঁতাত’। হেনরি কিসিংগারের মতে, দাঁতাত হল প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাত এবং সর্বোপরি পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানাের লক্ষ্যে চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সমঝােতায় গুরুত্ব আরােপ।
[1] অস্ত্র হ্রাস সম্পর্কিত সম্মেলন: পারমাণবিক যুদ্ধ ভীতি রাশিয়া এবং আমেরিকা দুই দেশকে পরস্পরের কাছাকাছিআনে।ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানে যে শীর্ষ সম্মেলনগুলির ভূমিকা ছিল সেগুলি হল-রুশ-মার্কিন জেনেভাশীর্ষ বৈঠক (১৯৮৫ খ্রি. ১৯নভেম্বর), ওয়াশিংটন শীর্ষ সম্মেলন (১৯৮৭ খ্রি. ডিসেম্বর), মস্কো শীর্ষ বৈঠক (১৯৮৮ খ্রি., ২৯মে), মাল্টা শীর্ষ বৈঠক (১৯৯০ খ্রি. ৯ সেপ্টেম্বর), প্যারিস শিখর সম্মেলন (১৯৯০ খ্রি. ১৯ নভেম্বর), মস্কো শীর্ষ বৈঠক (১৯৯১ খ্রি. ৩০ জুলাই) ইত্যাদি। তবে প্যারিস শিখর সম্মেলনেই কার্যত ঠান্ডা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছিল বলা চলে। কারণ, মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ নিজেই এই সম্মেলনকে ঠান্ডা লড়াই-এর সমাপ্তি বলে অভিহিত করেছিলেন।
[2] রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সােভিয়েত রাশিয়ার ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি জোটনিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বন করে এবং ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলি, বিশেষত ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আরও মজবুত করার জন্য তাদের রাজনীতিকে বিশ্বজনীন করার প্রয়াস গ্রহণ করে। এর ফলে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে।
[3] গর্বাচেভের ভূমিকা: সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানরূপে গর্বাচেভ গ্লাসনস্ত (মুক্তচিন্তা) ও পেরেস্ত্ৰৈকা (পুনর্গঠন)-এই দুই নীতির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে বিশ্বে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির উত্তেজনা প্রশমিত হতে শুরু করে।
[4] শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি: সােভিয়েত রাশিয়ার দিক থেকে প্রথমে ক্রুশ্চেভ, পরে ব্রেজনেভের আমলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি স্থাপন রুশ বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অপর দিকে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান প্রক্রিয়া শুরু হয়।
[5] বহুমেরু রাজনীতির উত্থান: ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরুতার পরিবর্তে বহুমেরুতার উত্থান ঘটতে শুরু করে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে চিনের উত্থান এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহণ বহুমেরু রাজনীতির উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় রাষ্ট্রই আরও সহনশীল হতে বাধ্য হয়। ফলে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির অবসান ঘটতে থাকে।
[6] জোটনিরপেক্ষ নীতি: ভারতের নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একে একে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে শুরু করলে এবং বহু ইউরােপীয় দেশ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়ােগে আগ্রহী হয়ে উঠলে সােভিয়েত এবং মার্কিন, দুই জোটের মধ্যেকার ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে দাঁতাতের উদ্ভব ঘটে।
[1] স্নায়ুযুদ্ধের অবসান: সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট যেভাবে বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল তা থেকে বিশ্বকে মুক্ত করেছিল দাঁতাত। লৌহযবনিকা তুলে নেওয়া হয়েছিল। ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রতীক বার্লিন প্রাচীর ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া কৃতিত্ব দাঁতাতের। দুই জোটের নেতৃত্বাধীন দেশগুলাে বুঝেছিল অস্ত্র নয়, নিরস্ত্রীকরণই আসল পথ।
[2] সামরিক জোটের প্রয়ােজনীয়তা হ্রাস: দাঁতাতের পর্বে সামরিক জোটগুলির প্রয়ােজনীয়তা হ্রাস পায়। SEATO, CENTO-র মতাে সামরিক জোটগুলি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে যায়। NATO-এর ওয়ারশ চুক্তিগুলিরও আবশ্যকতা কমে আসে। পূর্ব ইউরােপে কমিউনিস্টদের পতন শুরু হলে ওয়ারশ চুক্তিও বিলুপ্ত হয়।
[3] বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি: দাঁতাতের প্রভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। সােভিয়েত-মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসার ফলে পূর্ব-পশ্চিম ইউরােপ, সােভিয়েত পশ্চিম ইউরােপ, আমেরিকা-পূর্ব ইউরােপ, চিন-সােভিয়েত ও জাপান সােভিয়েত সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এই সমস্ত দেশগুলির মধ্যে দাঁতাতের পূর্বেকার তিক্ততার সম্পর্কের অবসান ঘটে। অর্থাৎ দাঁতাত এই দেশগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের শীতলতাকে উয়তায় বদলে দেয়।
[4] নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস: নির্জোট দেশগুলি ইতিপূর্বে ঠান্ডা লড়াইকালে নিজেদের নিরাপত্তার স্থায়িত্ব এবং আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যে সাম্যবাদী বা পুঁজিবাদী কোনাে জোটেই যােগ দেয়নি। কারণ, তারা কোনাে একটি জোটে যােগ দিয়ে অন্য জোটের বিরাগভাজন হতে চায়নি। এই লক্ষ্যে তারা নির্জোট আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। দাঁতাত রাজনীতি সেই নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস করে।
[5] ইউরােপের ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ়করণ: দাঁতাত রাজনীতি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলন ঘটায়। পাশাপাশি প্যারিস শীর্ষ বৈঠকের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরােপের বিভাজন কমিয়ে আনা হয়। ইউরােপের আঞ্চলিক বিরােধগুলির শান্তিপূর্ণ মীমাংসার রাস্তা তৈরি হয়। সার্বিক রূপে ইউরােপীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্র আগের তুলনায় অনেকটাই মজবুত হয়।
[6] অন্যান্য ক্ষেত্রে: সােভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই মহান শক্তিশালী দেশ দাঁতাতের জন্যই সামরিক খাতে বাড়তি খরচ থেকে সরে আসে। সেই অর্থ তারা জনকল্যাণমুখী কাজে খরচ করে। মুক্ত বাজার, অবাধ বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি—এই সবকিছু আসলে দাঁতাতের ফলশ্রুতি। দাঁতাতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবেই সন্ত্রাসবাদ বিরােধিতা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
Leave a comment