বীরাঙ্গনাকাব্যে মধুসূদন দত্ত যেকটি চরিত্রলিপি লেখিকা হিসাব নির্বাচন করেছেন তারা সকলেই পৌরাণিক চরিত্র। সবচেয়ে বেশি চরিত্র তিনি সংগ্রহ করেছেন মহাভারত থেকে। এইসব চরিত্রের কেউই ঠিক অবিকৃত পৌরাণিক ধারণা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থে উপস্থিত হয়নি, বস্তুত সেরকম হলে কবি সেই চরিত্রের প্রতি মমত্ববোধ করতেন না। চরিত্রের কোনো অস্ফুট বা অস্পষ্ট প্রবণতার সন্ধান পেলেই তিনি উৎসাহিত হয়েছেন এবং সেই স্পষ্টতর হবার পর স্বাভাবিকভাবে চরিত্রের দিকে পরিবর্তন ঘটেছে। চরিত্র প্রায় আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে দুটি ক্ষেত্রে এবং সেক্ষেত্রে বলতে গেলেও কৈকেয়ী এবং রাবণের ভগ্নী শূর্পণখা।
রাজা দশরথের স্ত্রী চন্দ্রবংশীয় রাজা কৈকেয়ীর কন্যা। রামায়ণে একে কৈকেয়ী বলে উল্লেখ করা য়েছে। মধুসূদন তাকে কৈকেয়ী বলে উল্লেখ করেছেন। রাজা দশরথের কাছে কৈকেয়ীর বর প্রার্থনা রামায়ণে যা পাওয়া যায় তা এই রকম। দেবাশূরের যুদ্ধে আহত হলে দশরথ কৈকেয়ীর সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে ওকে তিনি প্রসন্নচিত্তে একটি বরদানের কথা বললে কৈকেয়ী তা গ্রহণ করবে বলে। রাজা দশরথ যৌবরাজ্য অভিষিক্ত করবেন বলে ঘোষণা করেছেন তখন দাসী মন্থরার কু-পরামর্শ কৈকেয়ী দুটি বর প্রার্থনা করেন—স্বীয় সন্তান ভরতের রাজ্য এবং রামের বনবাস।
বীরাঙ্গনা কাব্যে চরিত্র সর্গে যেটুকু উপাখ্যান আমরা পাই সেটা রামায়ণে দশরথ নেই কৈকেয়ীও নেই। দশরথ অসুস্থ হলে কৈকেয়ীর সেবাগ্রহণ করছে এমন কথা কাব্যে পাওয়া যায় না। এখানে দেখি যৌবনে সম্পদে লোভনী দশরথের সঙ্গে কৈকেয়ী সংযোগ ঘটল সৌন্দর্যের আকর্ষণে। রাজা কামার্থ হয়ে রানির কাছে আসতেন এবং কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থতা ঘটলে উল্লাসিত হয়ে উঠতেন। এই উল্লাসিত মুহূর্তে কৈকেয়ীকে বর প্রার্থনা করতে হয়নি। নিজে রানিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সে তার পুত্র ভরতকে তিনি যৌবরাজ্য অভিষিক্ত করবেন। এমতাবস্থায় জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রের অভিষেকের আয়োজন দেখে বিস্মৃত কৈকেয়ী দশরথের সত্যভঙ্গের অপরাধে অপরাধী করেছেন। বিদ্রুপে ব্যঙ্গে তাকে পর্যুদস্ত করেছেন। যে দশরথকে জিতেন্দ্রীয় বলে সকলে শ্রদ্ধা করে সে দশরথও যদি সাধারণ কামুকের মতো নারীকে প্রবঞ্চনা করে তার দেহসুধা পান করে থাকে তাহলে অবশ্য কৈকেয়ী কিছু বলার কিছু নেই—
“কাম মদে মতি যদি তুমি—
বৃথা আশা দিয়া মোর ছলিনা তা কহং—
নীরবে এ দুঃখ আমি সহিব তাহলে!”
কিন্তু কৈকেয়ী এ অভিশাপ নিশ্চয়ই দেবে—
“থাকে যদি ধর্ম, তুমি অবশ্যাভুঞ্জিবে
এ কর্মের প্রতিফল!”
আসলে অভিশাপের জোর কৈকেয়ী পায় তার সত্যনিষ্ঠা থেকে কোনো অক্ষমার্থ কথা সে বলছে না। এ বোধ তার আছে—
“অ যথার্থ কথা যদি মুখে
কৈকেয়ী মাথা তার কাটাতাম আসি।
কিন্তু তার কথায় সত্যনিষ্ঠা আছে বলেই এমন কথা তার মুখে আমরা শুনি—
“হ ধিক! কি করে দাসী গুরুজন তুমি
নতুবা কৈকেয়ী, দেব মুক্ত কণ্ঠে আজি
কহিত, ‘অসত্যবাদী রক্ষ-কুল-পতি!
নির্লজ্জ ! প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙ্গেন সহজে,
ধর্ম শব্দমুখে, গতি অধর্মের পলে!”
কৈকেয়ী এখানে মোটের গোপন স্বভাবের নারী নয়। মন্থরা দাসীর কথা শুনে তার মনে নিজের মনে রাজ্যাভিষেকের কথা মনে হয়নি। সুন্দরী এক নারী, রূপের আকর্ষণে সে নারীকে বেধে রেখেছিল, স্বামীর কাছ থেকে নিজ পুত্রকে রাজা করার প্রতিশ্রুতি সে পেয়েছিল। অকস্মাৎ অকারণে সেই সত্যভঙ্গ হতে দেখেই তার ক্রোধ এবং বেদনা উদ্দীপিত হয়েছে।
কৈকেয়ীর পত্র শুরু হয়েছে একটি নাট্যচমক দিয়ে—“এ কি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে রঘুরাজ ?” পত্র রচনার স্বাভাবিক রীতি এবং নায়িকার সংলাপে প্রথাগত বাগ্ ব্যবহারও বলা চলে না অথচ মন্থনার মুখে কৈকেয়ী কী শুনেছে সে কথাটা সে উচ্চারণ করেনি, এজন্য—নাটকীয় প্রতিজ্ঞা গড়ে তুলতে সে পর পর কিছু অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এই অনুমানের মধ্যেও নাটকীয়তা কম নেই। রাজ্যের সর্বত্র আনন্দ উৎসব তার নজরে পড়েছে। শুধু রাজপুরীর বাইরে নয়, রাজপুরীর ভেতরেও উৎসবের সাজ সাজ রব। অথচ রাজা দশরথের অন্যতমা মহিষী হিসাবে সে কিছুই জানে না, এই বৈপরীত্য আমাদের পীড়িত করে। সে অনুমান করেছে কোনো নতুন যজ্ঞ আরম্ভের, কোনো প্রধান নিপাতের, কোনো নতুন বিবাহের তার শেষতম অনুমানটি নাটকীয় শ্লেষের এক সুন্দর দৃষ্টান্ত তার মনে হয়েছে দশরথ নিজে বোধহয় এ বয়সে নতুন করে সুন্দরী রমণীর পাণিগ্রহণ করতে চলেছেন। অথচ এই উৎসবের বর্ণনা এবং অনুমানের ক্রমানুসারের ধারা পাঠককে চরম সীমায় নিয়ে যায়। কারণ কৈকেয়ী পত্রিকায় সূচনাতেই জানিয়ে রেখেছেন এ উৎসবের প্রকৃত রহস্য ক্ষেত্রে জেনেছিলেন দাসী মন্থরার কাছে।
এরপরে কৈকেয়ী দশরথকে অসত্যবাদী বলে সম্বোধন করে তখন আমাদের কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগে, কারণ রামায়ণের পিষ্টপাট থেকে আমরা জানি যে দশরথ তাকে দুটি বর দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন মাত্র–কিন্তু সত্যভঙ্গ করার মতো আচরণ তিনি করেননি। রাজা কৈকেয়ীর কাছে সত্যবদ্ধ হয়েছিলেন তার সেবার পরকাষ্ঠায় রূপে সে ভোলাননি আমরা রামায়ণ থেকে পেয়ে থাকি। সুতরাং আমাদের বিষয়ে নহে আমাদের বসে—যার মধ্যে প্রার্থনা পেয়েছে দশরথের কামাকে বলেছে—
“না পড়ি ঢলিয়া আর নিতম্বের ভারে !
নহে গুরু উরুদ্বয়, বর্ভুল কন্দলী-
সদৃশ, সে কটি, হায়, কর পদ্মে ধরি
যাহায়, নিন্দীতে তুমি সিংহে প্রেমোদরে,
আর নহে সরু, দেব। নম্র শিরঃ এবে
উচ্চ কুচু! সুধাহীন অধরা !”
এরপর প্রচণ্ড নাটকীয় চমকের মধ্যে আমরা জানতে পারি সেই তথ্য রাম আমাদের জানায় না। জানায় কবি মধুসূদন দত্ত যে দশরথ যুদ্ধে আহত সেবা পেয়েছিলেন কৈকেয়ীর কাছে, তাকে বর দিয়েছিলেন—সেই প্রাচীন গাথা নতুন করে শোনাতে বসেননি কবি। দশরথ কৈকেয়ীর যৌবন সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে কামতৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন কৈকেয়ীর অপরূপ দেহ সৌন্দর্য উপভোগ করে। কামের পরিতৃপ্তি সাধিত হওয়াতেই তৃপ্ত দশরথ কৈকেয়ীর আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তার সন্তানটি ভবিষ্যৎ যুবরাজ হবে। এই সংবাদটির উন্মোচন যথেষ্ট নাটকীয় বলেই আমরা বিবেচনা করি।
এরপর কৈকেয়ী যেভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বলেছেন ও প্রায় অতিনাটকীয় বলা চলে। কামতৃথ্বা মেটাবার সময় সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যদি তিনি সেই প্রতিশ্রুতি না রাখেন তবে সে সমস্ত বৈভব ত্যাগ করে ভিখারিনী বেশে এরা পাপরাজপুরী ছেড়ে চলে যাবে। সেই সঙ্গে নিয়ে যাবে পুত্র ভরতকে। অবশ্য কৈকেয়ী তার পিত্রালয়ে ও থাকবে না। পলে পলে ঘুরবে অন্য এক সংকল্প নিয়ে, ভরতের প্রতি অবিচার করবে তার পিতা।
‘মাতা মহালয়ে পাবে আশ্রয় বাচুনি।
দিব্যদিয়া মানা তারে করিব যাইতে।
তব অন্ন, প্রবেশিতে তব পাপ পুরে।”
কৈকেয়ী তার নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে যে সংকল্প ব্যক্ত করেছেন তা আরও নাটকীয়। পত্রে তার সংলাপের যে নাটকীয়তা ফুটে উঠেছে উদ্ধৃতি সাহায্য না নিলে তা পরিস্ফুট করা অসম্ভব। প্রথমে কৈকেয়ী বলেছেন—
“দেশ-দেশান্তরে
ফিরিব; যেখানে যাব কহিব সেখানে ;
পরম অধর্ম্মচারী রঘু-কুলপতি।”
“পরম অধর্মাচারী রঘু-কুল-পতি”। তারা সর্বদা গেয়ে যাবে এই গান। অরণ্যে সে গান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে। নিবিড় অরণ্যের গাছের ছালে কৈকেয়ী লিখে রাখবে দশরথের কথা, পাহাড়ের বুকেও মুদ্রিত করবে এই লিপি তাতেও তার শান্তি নেই, সে আরও বলেছে—“রুচিগাথা শিখাইবে পল্লি জল ফলে।”
করতালি দিয়া তারা গাহিবে নাচিয়া-
“পরম অধৰ্ম্মচারী রঘু-কুল পতি।”
সংলাপের এই সমগ্র চতুর্থ সর্গই উচ্চকিত এবং বিচ্ছিন্ন কোনো চরিত্রের এবছর সংলাপ বা “Dramatic Monolgue” হিসাবে গৃহীত হলেও এর মূল্য কিছুমাত্র কমে না। বস্তুত বীরাঙ্গনা কাব্য যে নাট্যগুণ সমৃদ্ধ। এই সর্গ তারই সুনিশ্চিত প্রমাণ।
Leave a comment