প্রাক্-তুর্কী যুগ:
বাঙলা সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত কালসীমাকে প্রাচীন যুগ বা আদিযুগ বলে অভিহিত করা হলেও ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি প্রাচীন যুগের অন্ত্যপর্ব। বাঙলাদেশ ছিল মূলতঃ অনার্য-অধ্যুষিত অঞ্চল। তবে খ্রীঃ পূঃ মৌর্যযুগেই যে এখানে সর্বপ্রকারে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তার পাথুরে প্রমাণ বর্তমান থাকলেও ঐ ধারায় নিরবচ্ছিন্নতা ছিল না। এরপর খ্রীঃ পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণ সম্ভবত সমগ্র বাঙ্লাদেশকেই তাদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ে আসবার পর বাংলায় আর্যীকরণ পদ্ধতি আর কখনাে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। কিন্তু তখনাে বাঙ্লায় কোন স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। সপ্তম শতকের একেবারে গােড়াতেই শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত সর্বপ্রথম গৌড়েশ্বর উপাধি গ্রহণ করেন এবং সম্ভবত তখনই গৌড়বঙ্গ একটা রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছিল। গুপ্ত শাসনকাল থেকে তথা শশাঙ্কর আমল থেকেই প্রকৃতপক্ষে বাঙলার প্রাচীন যুগ শুরু। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর শতাব্দীকাল গৌড়বঙ্গে চলছিল ‘মাৎস্যন্যায়। অষ্টম শতকের মধ্যভাগে বপ্যট-পুত্র গােপালদেব প্রজাসাধারণ ও রাজকর্মচারিদের দ্বারা রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী তিন শতাব্দীকালে এঁর বংশধররাই প্রকৃতপক্ষে গৌড়বঙ্গের ভাগ্যবিধাতা-রূপে বর্তমান ছিলেন। দ্বাদশ শতকের তিন চতুর্থাংশ কাল রাজদণ্ডের অধিকারী ছিলেন সেন বংশ। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের দু’তিন বছর আগে পরে সেনবংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেন ইতিয়ারউদ্দিন বিন্ বক্তিয়ার খিলজির নিকট পরাজিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। ফলতঃ এখানেই সেন বংশীয়দের সার্বভৌম অধিকার ক্ষুন্ন হলাে। প্রাচীন যুগের সমাপ্তিও এখানেই।
ধর্মীয় প্রভাব: অতএব ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরা-বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত তিন শতাব্দীকাল গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে আসীন ছিলেন অধিকাংশ পাল রাজবংশ এবং অপরাংশে সেন রাজবংশ। অবশ্য এই শাসনকালের মধ্যেই স্থানীয়ভাবে বৌদ্ধমতাবলম্বী খড়গ- বংশ এবং ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী বর্মণবংশও কিছুকাল রাজত্ব করেছিল, তবে সমগ্র দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রভাব ছিল নগণ্য। পালরাজগণ ছিলেন বৌদ্ধ, তবে তাদের পরধর্মসহিষ্ণুতারও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কর্ণাটদেশীয় সেনবংশীয় রাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী, সম্ভবত অপর ধর্মের প্রতি তাদের ততটা সহনশীলতা ছিল না। বৌদ্ধধর্মানুগত পালরাজাদের তিন শতাব্দীকাল-ব্যাপী রাজ্যশাসনকালে গৌড়বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের প্লাবন ঘটেছিল যতখানি, ব্রাহ্মণ্যধর্ম সেই তুলনায় ছিল প্রায় নগণ্য। এটি শুধু গৌড়বঙ্গের অবস্থাই নয়, সমগ্র ভারত-ভূমিতেই বৌদ্ধপ্রভাব ছিল অনুরূপভাবেই প্রসারিত। এই সময় শঙ্করাচার্য এবং কুমারিল ভট্টের আবির্ভাব বৌদ্ধপ্রভাবকে যথেষ্ট মন্দীভূত করে এবং ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী সেনরাজাদের আনুকূল্যে হিন্দুধর্ম যে শুধু পুনরুজ্জীবিত হলাে, তাই নয়, বৌদ্ধধর্মও ক্রমবিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলে।
সাহিত্যচর্চায় ভাষা-ব্যবহার: পালবংশের রাজারা শুধু পরমতসহিষ্ণুই ছিলেন না, তারা হিন্দু পুরাণের অনুশীলনেও আনন্দ লাভ করতেন। তাঁরা বাঙালীর সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা সমকালীন বাঙালীর ধর্মবােধেই বিশ্বাসী ছিলেন, বিভিন্ন তাম্রপত্রে তাঁরা জনসাধারণের কথাই বিশেষভাবে বলে গেছেন। সেই তুলনায় সেনগণ বাঙলার সংস্কৃতিকে গণমানস হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া পুরােহিতের সাহায্যে একটা কৃত্রিম বৈদিক স্মার্ত সংস্কৃতির দুর্বহ ভার সাধারণ বাঙালীর শিরে চাপাইয়া দিয়াছিলেন। এছাড়াও সে যুগের স্মার্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ জাত-বর্ণ ব্যবস্থাকে সমাজে দৃঢ়ভাবে কায়েম করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। ফলে বঙ্গসমাজ মর্যাদা ও সামাজিক আচরণের ভিত্তিতে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। নিম্নবর্ণের অসংখ্য মানুষ, সমাজের বৃহৎ শ্রমজীবী শ্রেণী ও বিপুল সংখ্যক অব্রাহ্মণ সম্প্রদায় সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অবিচারের শিকার হয়েছিলেন। ফলে বঞ্চিত ও নিপীড়িত এই বৃহৎ জনসমাজের মনে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তথা ব্রাহ্মণ-শাসনের প্রতি কোনাে সহানুভূতি ছিল না। পক্ষান্তরে বৌদ্ধধর্মে অস্পৃশ্যতা বা বর্ণবিভাজনের কোনাে স্থান না থাকায় সমাজের নিচুতলার মর্যাদাহীন মানুষগুলি স্বভাবতই বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল শাসকশ্রেণীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই। অতএব সমসাময়িক কালে সেনরাজাদের এই আচরণ দেশবাসীর সমর্থন লাভ করেনি এবং সম্ভবতঃ সেন রাজবংশের এত দ্রুত পতনের এটিও একটি মুখ্য কারণ ছিল। সেনরাজগণ বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদসাধনে ছিলেন সচেষ্ট। তার ফলে একদিকে বহু বৌদ্ধ হিন্দুধর্ম গ্রহণে বাধ্য হলেও অনেকেই যে সেনরাজবংশের উচ্ছেদসাধনেও তৎপর ছিলেন, এরূপ মনে করবার কারণ রয়েছে। সেন রাজত্বকালে সামন্তরাজগণ কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে স্বাধীন হবার চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই; বৈদিক ব্রাহ্মণ্য মতবাদ নিম্নবর্গের জনসাধারণের নিকট গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয় নিতারা বজ্রযান, সহজযান, নাথধর্ম প্রভৃতি অব্রাহ্মণ্য ধর্মমতের প্রতিই | সমধিক আকৃষ্ট হয়েছিলেন; বিদেশী সেনরাজদের বাঙালী আপন জন বলে ভাবতে পারেনি বলেই তুর্কীদের বিরুদ্ধে কোন উল্লেখযােগ্য প্রতিরােধ গড়ে ওঠেনি। এমন কি লামা তারানাথের উক্তিতে আস্থা স্থাপন করলে স্বীকার করতে হয় যে বৌদ্ধগণ নাকি বক্তিয়ার খলজির গুপ্তচরের কাজ করেছিলেন শুধু তাই নয়, লক্ষ্মণসেনের সভাসদগণও ভবিষ্যদবাণীর দোহাই দিয়ে রাজাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছিলেন যে রাষ্ট্রশক্তি শীঘ্র তুর্কীদের করতলগত হবে—এইভাবে গােড়াতেই রাজার মনােবল নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।
সেন বংশের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা: পালরাজগণ ব্রাহ্মণ্য মতের প্রতিকূলতা না করলেও রাজধর্মের আশ্রয়পুষ্ট বৌদ্ধগণের প্রাধান্য বজায় থাকায় সমাজে জাতিভেদ প্রথা তখন চরম রূপ লাভ করতে পারেনি। বরং বৌদ্ধতান্ত্রিকতা, হিন্দুতান্ত্রিকতা, কৌলধর্ম, নাথধর্ম প্রভৃতির মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চলছিল। তৎকালীন অভিজাত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদিই শুধু সংস্কৃত পুরাণ ও স্মৃতিসংহিতা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু জনসাধারণ সম্ভবতঃ অপভ্রংশ, অবহটঠ এবং দেশীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে উৎসাহ বােধ করতেন। সেনবংশের শাসনকালে আবার সংস্কৃত-আলােচনার পুনরুজ্জীবন ঘটে। মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা-বিষয়ে নিষেধ বাণীটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য :
“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বয রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।”
অর্থাৎ ভাষায় (মাতৃভাষায়) পুরাণ-মহাকাব্যাদি শুনলেও নরকে যেতে হবে। ফলতঃ ঐ যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীরা মাতৃভাষায় সাহিত্য-রচনায় সাহসী হন নি। তারা সংস্কৃতেরই শরণ নিয়েছিলেন। লক্ষ্মণসেনের রাজসভার পঞ্চকবি উমাপতিধর, শরণ, ধােয়ী, গােবর্ধন আচার্য এবং কবিরাজ গােস্বামী জয়দেবের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তবে, বুদ্ধোত্তর কালে বৌদ্ধগণ যেমন সংস্কৃতের একাধিপত্য অস্বীকার করে দেশীয় ভাষা প্রাকৃত কথ্য পালি ভাষায় তাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করেছিলেন, বাঙলা সাহিত্যের আদিযুগেও তারা তেমনি সংস্কৃতকে এবং শিষ্টজনগ্রাহ্য অবহটঠ ভাষাকেও উপেক্ষা করে দেশীয় ভাষা তথা বাঙ্লায় তাদের গুহ্য সাধন পদ্ধতি চর্যাপদ রচনা করেছিলেন।
শ্রেণীবিভাগ: সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের চর্যাপদগুলিতে আমরা তৎকালীন সমাজজীবনের একটা সুস্পষ্ট চিত্রের সন্ধান পাই। তবে এই চিত্র সমাজের উচ্চ অভিজাতদের নয়, সম্ভবতঃ বৌদ্ধধর্মাচারী সমাজের নিম্নকোটির জনসাধারণের। এদের মধ্যে আছে তাঁতী, জেলে, শবর, ডােম, চণ্ডাল, প্রভৃতি অন্ত্যজ শ্রেণী। সমাজে জাতি-বিন্যাস পদ্ধতির কড়াকড়ি দেখা দিয়েছিল সেন রাজত্বকালে। সেনবংশীয় রাজা বল্লালসেনই কৌলীন্য প্রথার সৃষ্টি করেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। এই আমলেই বহু বৌদ্ধ হিন্দুসমাজে প্রবেশাধিকার লাভ করায় সমাজব্যবস্থায় নানা রূপান্তর ঘটে। এই সময়ই হিন্দুদের মধ্যে বহুজাতি- উপজাতির উদ্ভব ঘটে এবং সমাজে তাদের স্থান নির্দেশ করে উত্তম সঙ্কর, মধ্যম সঙ্কর, অন্ত্যজ, ম্লেচ্ছ প্রভৃতি শ্রেণীবিভাগ করা হয়।
উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ ব্রাহ্মণ্যমতের অনুগামী হলেও অপর সাধারণের মধ্যে দু’টি লােকায়ত অবৈদিক ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তান্ত্রিক বৌদ্ধদের একটি শাখা সহজিয়াগণ এবং শৈব নাথপছ্থীগণ দেহধর্মকে অস্বীকার না করে কায়াসাধনের মাধ্যমেই মুক্তির উপায় সন্ধান করেছেন। এই দুই শ্রেণীর কেউ ঈশ্বর-ভাবনায় কোন গুরুত্ব আরােপ না করে গুরুবাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
চর্যাপদে মানব-জীবন: চর্যাপদগুলিতে তৎকালীন যে সমাজ-জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে ব্রাহ্মণদের পরশ্রমজীবী বলেই মনে হয়। তারা নিষ্কর জমি ও নানাবিধ সুখ-সুবিধা ভােগ করতেন। চর্যায় অবশ্য বিশেষভাবে নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয়ই বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। সে জীবন ছিল বড় কঠোর, জীবনযাত্রার মান ছিল অতিশয় নিম্ন এবং এদের সকলকেই কায়িক শ্রমের উপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হতাে। যৌথ পরিবার প্রথাই তৎকালে প্রচলিত ছিল।
সাহিত্য-প্রচেষ্টা: এই আদি যুগে অবহটঠ ভাষায় রচিত দোহা এবং কিছু কিছু প্রকীর্ণ শ্লোকে সম-সাময়িক জীবনের ছবি কিছুটা পেলেও পরবর্তী সাহিত্যধারায় যে দুটি গ্রন্থের প্রভাব অতিশয় উল্লেখযােগ্য, তাদের একটি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত জয়দেব গােস্বামীর গীতগােবিন্দ এবং অপরটি সদ্যঃ-সৃষ্ট বাঙলায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত চর্যাপদ। গীতগােবিন্দের স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায় বিভিন্ন কাহিনী-কাব্যের গঠনে এবং পদাবলী-সাহিত্যের সর্বস্তরে; চর্যাপদের প্রভাব পদাবলী সাহিত্যে (সহজিয়া পদে) এবং বিশেষতঃ বাউল গানে। বস্তুতঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত এই আদিযুগই যে পরবর্তী যুগের ভিত্তি-স্থাপন করেছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
Leave a comment