রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের কাঠামোগত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক দলের কাঠামোর প্রকৃতির উপর দলের ভূমিকা ও কার্যাবলী বিশেষভাবে নির্ভরশীল। সকল রাজনীতিক দলের কাঠামোগত ভিত্তি অভিন্ন প্রকৃতির নয়। অর্থাৎ রাজনীতিক দলগুলির কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। এই কাঠামোগত পার্থক্য রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। এই কাঠামোগত পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। অর্থাৎ দলীয় কাঠামোর নির্ধারকসমূহ সম্পর্কে পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। দলীয় কাঠামো নির্ধারণকারী উপাদানসমূহ বহু ও বিভিন্ন। দলীয় কাঠামো একাধিক নির্ধারকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই সমস্ত নির্ধারকের মধ্যে প্রভাব ও গুরুত্বের বিচারে তারতম্য আছে। বস্তুতপক্ষে এই সমস্ত উপাদানের দলীয় কাঠামোর সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। এই কারণে এ বিষয়ে অধিকতর বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আবশ্যক। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “…the relationship of party structures to these various factors is one of great complexity, and far more analytical detail is needed for any explanation to be entirely satisfactory.”

রাজনীতিক দলের কাঠামোর নির্ধারক হিসাবে অ্যালান বল নিম্নলিখিত উপাদানসমূহের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দলীয় কাঠামোর নির্ধারক এই সমস্ত বিষয়গুলি হল:

  • রাজনীতিক মতাদর্শ,
  • সরকারের সাংগঠনিক কাঠামো,
  • আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহ,
  • জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম,
  • রাজনীতিক সংস্কৃতি,
  • ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ প্রভৃতি।

রাজনীতিক মতাদর্শ

যে-কোন রাজনীতিক দল নির্দিষ্ট কোন রাজনীতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। প্রত্যেক রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর নির্ধারক হিসাবে এই রাজনীতিক মতাদর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনীতিক দলমাত্রেই তার নির্দিষ্ট মতাদর্শগত ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব ও কার্যক্রম নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলগুলি স্পষ্টত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কোন কোন দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে; আবার কোন কোন রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থনসূচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। রাজনীতিক মতাদর্শগত ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি রাজনীতিক দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। বিদ্যমান ব্যবস্থা-বিরোধী দলগুলির প্রতি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ বা শাসকদল সাধারণত দমন-পীড়নের নীতি অবলম্বন করে। তার ফলে এই সমস্ত দলের পক্ষে প্রকাশ্যে যাবতীয় রাজনীতিক কাজকর্ম পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় এই সমস্ত রাজনীতিক দল গোপন দলীয় সংগঠন গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। সমকালীন পরিস্থিতির প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা-বিরোধী রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে সাধারণত এককেন্দ্রিকতার প্রবণতা দেখা দেয়। অনেক সময় এই সমস্ত দল গণতান্ত্রিক এককেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি এই সমস্ত রাজনীতিক দলের বিরোধিতার মনোভাব প্রকাশিত হয় দলের আনুষ্ঠানিক কাঠামো, কার্যপদ্ধতি, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য প্রভৃতির মাধ্যমে। বল বলেছেন: “If the party sees its goods as antagonistic to the existing political structures, its organisation will reflect not only the party’s hostility to the prevailing norms, but also a readiness to defend itself against any repressive measure that this hostility has produced among the dominant political elites.” অপরদিকে যে সমস্ত রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন তাদের সাংগঠনিক কাঠামো অন্য ধরনের হয়। এই সমস্ত দল সাধারণত বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার মতাদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি সমর্থনসূচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। এই কারণে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত দলের প্রতি কোন রকম পীড়নমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে না। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার অনুপন্থী দলগুলি প্রকাশ্যেই যাবতীয় রাজনীতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। এদের গোপনে দলীয় কাজকর্ম সম্পাদন করতে হয় না। তারফলে এই সমস্ত দলের এককেন্দ্রিকতার প্রবণতা বড় একটা পরিলক্ষিত হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক মতাদর্শগত ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি রাজনীতিক দল অবশিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি তার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। এবং তদনুসারে সংশ্লিষ্ট দলের সাংগঠনিক কাঠামো বহুলাংশে নির্ধারিত হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “…the ideological framework of the party is an important factor in how the party relates to the rest of the political system, and therefore will have an important bearing on the structure of the political party.”

সরকারের সাংগঠনিক কাঠামো

রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হল সরকারের কাঠামো। রাজনীতিক দলের সাংবিধানিক কাঠামো সাধারণত বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও সরকারী কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। অ্যালান বল বলেছেন: “…the organisational structure of the party also responds to the existing political institutions and structures of Government.” যেমন এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীভূত সাংগঠনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনীতিক দলকে তার কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয়। এই কারণে এককেন্দ্রিক সরকারী কাঠামোতে রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো এককেন্দ্রিক হয়। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলকে বিকেন্দ্রীভূত সংগঠনের মাধ্যমে দলীয় কাজকর্ম‌ পরিচালনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারী কাঠামোতে রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিকেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে। বল বলেছেন: “A federal structure of Government is more likely to produce decentralised parties.” আবার রাষ্ট্রপতি-শাসিত সংসদীয় সরকারের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এই কারণে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে দলীয় সাফল্যের বিচার-বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে বিন্যস্ত করা হয়। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের উদ্দেশ্য হল সংসদে দলের সদস্যসংখ্যাকে সর্বাধিক করা। তাই ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন এবং প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দলীয় সংগঠনকে মজবুত করার দিকে নজর রেখে দল তার সাংগঠনিক কাঠামোকে বিন্যস্ত করে। বল বলেছেন: “…presidential elections will have different effects on the nature of the party leadership than the less individualised parliamentary elections.”

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় সকল দেশেই রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো অভিন্ন ধরনের হবে, এমন কথা বলা যায় না। উদাহরণ হিসাবে ভারত ও গ্রেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার কথা বলা যায়। এই দুটি দেশেই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বর্তমান। কিন্তু এই দুটি দেশের রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো একই ধরনের নয়।

আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহ

বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উপাদানের দ্বারাও রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো প্রভাবিত হয়। বল বলেছেন: “Socio-economic factors are also important in the determination of party structures.” কোন দেশের রাজনীতিক দলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, তার মাত্রা ও স্থায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থনীতিক বিকাশের ব্যাপকতা ও মাত্রার উপর নির্ভরশীল। আর্থনীতিক বিকাশের ভিত্তিতে দেশে মালিক শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থবাহী বিভিন্ন রাজনীতিক দলের উদ্ভব হয়। এই দুই শ্রেণীর রাজনীতিক দল পরস্পর-বিরোধী দুটি সামাজিক মেরুতে অবস্থান করে। এবং এই দুই শ্রেণীর রাজনীতিক দল যে যার দলীয় সংগঠনকে মজবুত করে একে অপরের প্রতিরোধের ব্যাপারে সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। এই কারণে দলীয় কাঠামোর নির্ধারক হিসাবে আর্থনীতিক বিকাশের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “The level of economic development will influence the nature of the party competition and whether that competition endures and so affects the nature of the parties.” আবার গ্রাম ও শহর ভেদে আর্থনীতিক বিকাশ ও আনুষঙ্গিক পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে রাজনীতিক চিন্তা-চেতনা এবং সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তার ফলে যে-কোন দেশের এই দুই অঞ্চলে রাজনীতিক দলের কাজকর্মের মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এই কারণেও রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দেয়।

জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম

ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এবং অনেক সময় এই প্রভাব সামাজিক শ্রেণীর প্রভাবের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “Nationalism and religious divisions may be more important than class in forming the basis of some political parties.” ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো এক ধরনের হয়। এই ধরনের রাজনীতিক দলে কোন একটি শ্রেণীর নেতৃত্ব বা প্রাধান্য থাকলেও অন্যান্য শ্রেণীর সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতার উপর জোর দেওয়া হয়। আবার ধর্মীয় আনুগত্যের ভিত্তিতেও রাজনীতিক দল সংগঠিত হতে পারে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে পার্থক্য সত্ত্বেও অভিন্ন ধর্মীয় আনুগত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিবর্গ একই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এবং এরই ভিত্তিতে একটি রাজনীতিক দল গড়ে উঠতে পারে। ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতিক দলে সামাজিক শ্রেণীগত পার্থক্যের কোন তাৎপর্য থাকে না।

রাজনীতিক সংস্কৃতি

রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর উপর ঐতিহাসিক উপাদানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতিক দল মাত্রেই ঐতিহাসিক বিষয়াদির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। সমকালীন ঐতিহাসিক পরিস্থিতির প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে বিন্যস্ত করা যায় না। অ্যালান বল বলেছেন: “Historical factors are the utmost significance in the determination of party structure.” আধুনিক রাজনীতিক প্রক্রিয়ার বিকাশের ফলশ্রুতি হিসাবে রাজনীতিক দলব্যবস্থার আবির্ভাব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় মাত্রায় নগরায়ণ এবং জনসংযোগ সাধন ব্যবস্থার উন্নয়ন দলীয় ব্যবস্থার আবির্ভাবের জন্য অপরিহার্য বিবেচিত হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “Parties are creation of modern political process, and their emergence presupposes a necessary degree of urbanisation and development of mass communications.” অর্থাৎ আধুনিক রাজনীতিক প্রক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পরিণতি হল রাজনীতিক দলের উদ্ভব।

আবার বলা হয় যে যখন ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে, তখন রাজনীতিক দলের উদ্ভব হয়। এবং অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে বৈজ্ঞানিক বিধি-বিধানের দ্বারা রাজনীতিক দলের আবির্ভাবের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি বলেছেন: “Parties arise when historical changes occur, and these are not subject to scientific laws.” কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি বা পদ্ধতি অনুসারে রাজনীতিক দলের উদ্ভব বা বিকাশ ঘটে না। প্রকৃত প্রস্তাবে, এ বিষয়ে এ ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি নেই বা থাকা সম্ভব নয়। এই কারণে বিভিন্ন রাজনীতিক দলের বিকাশের বিষয়টি মোটেই সমজাতীয় নয়, বরং বিশেষভাবে অবিন্যস্ত রাজনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজন থেকে এই বিষয়টি ততটা স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় না। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, শিল্পবিপ্লব প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনার ফলশ্রুতি হিসাবে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয়। এবং এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরিণতি হিসাবে রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন সাধিত হয়। বল বলেছেন: “In Western Europe the extension of the franchise forced the existing conservative and liberal parliamentary groups to form national organisations to appeal to a wider electorate in order to capture or maintain power” গ্রেট ব্রিটেনের ১৮৬৭ সালের সংস্কার আইনের মাধ্যমে কিছু শ্রমিক-শ্রেণীর কাছে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয়। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জাতীয় ইউনিয়ন’ (National Union) গঠিত হয়। এই জাতীয় ইউনিয়ন হল ভোট সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গঠিত রক্ষণশীল দলের একটি জাতীয় সংগঠন। শ্রমিকদের সমর্থন অর্জনের আশায় এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়নের কংগ্রেস ১৮৯৯ সালে একটি সংসদীয় ও নির্বাচনী সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এইভাবে শ্রমিক দল গঠিত হয়। সংসদের বাইরে থেকে এই দল গঠিত হয়। বল বলেছেন: “The slight extension of the electorate in 1832 had led to the setting up of local registration societies which were limited in their scope.”

অ্যালান বল আর একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিষয়টি হল, আইনসভার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্প্রসারিত রূপই হল রাজনীতিক দল অথবা আইনসভার মধ্যে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে আইনসভার বাইরেই রাজনীতিক দলের সৃষ্টি হয়েছে তা বিচার-বিবেচনা করা। এই কথা ঠিক যে, আইনসভার পরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্তভাবে সকল রাজনীতিক দলের সৃষ্টি হয় না। বল বলেছেন: “…not all political parties originated in relation to the legislative structure.” আইনসভায় আসন দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে সব সময় রাজনীতিক দল গড়ে তোলা হয় না। অনেক সময় আইনসভার ভিতরে বিরোধী দল গঠন করার কোন সুযোগ থাকে না। তা ছাড়া সংকটকালীন সময়ে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজনীতিক দল বা বিভিন্ন বিপ্লবী দল গঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির কথা বলা যায়। জারের আমলে দমন-পীড়নমূলক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সঙ্গোপনে ষড়যন্ত্রমূলক সংস্থা হিসাবে এই বলশেভিক দলের উদ্ভব হয়। এ ছাড়া এই দলের স্রষ্টাদের সামনে অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। এ প্রসঙ্গে বল আরও বলেছেন: “Colonial liberation movements are not often given the option of constituting a parliamentary opposition to the existing government, and originate either as urban underground parties or as rural guerrilla organisation.” তবে সাধারণত সংকটকালীন পরিস্থিতিতেই এ ধরনের দলের সৃষ্টি হয়। যখন ক্ষমতাসীন রাজনীতিক এলিটদের ক্ষমতার আইনসঙ্গততা বা ন্যায়সঙ্গততা জনগণ অনুমোদন করে না, তখনই নতুন কোন গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে উদ্যোগী হয়। তবে আইনসভার বাইরে যে সমস্ত রাজনীতিক দলের উদ্ভব হয়, সেগুলির আবির্ভাব ঘটে সমকালীন ক্ষমতাসীন রাজনীতিক এলিটদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসাবে। এই সমস্ত দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে সাধারণত প্রবল কেন্দ্রিকতার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “Externally created parties involve challenges to the existing dominant elites, they tend to be more centralised and are less diferential to the existing political institutions….” তবে এই বক্তব্যের একটি বিশিষ্ট ব্যতিক্রম হল ব্রিটেনের শ্রমিক দল।

সমকালীন ঐতিহাসিক অবস্থা এবং ভোটাধিকারের ব্যবস্থা রাজনীতিক দল এবং দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। আধুনিককালের রাজনীতিক দলের আবির্ভাবের পিছনে ভোটাধিকারের সম্প্রসারণের কথা বলা হয়। গ্রেট ব্রিটেনে ১৮৩২ সালের আগে পর্যন্ত ভোটাধিকারের ব্যবস্থা ছিল সীমাবদ্ধ। সীমিত সংখ্যকের ভোটাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে তখন সংগঠিত কোন রাজনীতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি। তারপর ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয়। তখন নির্বাচক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সঙ্গে সংসদীয় গোষ্ঠীর সংযোগ সাধনের স্বার্থে রাজনীতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং রাজনীতিক দল গঠন করা হয়। অর্থাৎ ভোটাধিকারের সম্প্রসারণের ফলশ্রুতি হিসাবে সংগঠিত রাজনীতিক দলের সৃষ্টি হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে যে পরিস্থিতি বর্তমান থাকে তার প্রভাবকে কোন রাজনীতিক দলই উপেক্ষা করতে পারে না। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার প্রাধান্য বর্তমান। অপরদিকে ফ্রান্স ও হল্যাণ্ডে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। দলীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই পার্থক্য বিদ্যমান আর্থ সামাজিক বিন্যাস, রাজনীতিক সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর নির্ধারক প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের আলোচনা আবশ্যক। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা অর্জন এবং অর্জিত ক্ষমতা সংরক্ষণ পদ্ধতির দ্বারা দলের সাংগঠনিক কাঠামো প্রভাবিত হয়। যে-কোন রাজনীতিক দলেরই মুখ্য উদ্দেশ্য হল রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জন এবং তা সংরক্ষণ। প্রতিটি রাজনীতিক দল এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে তার সাংগঠনিক কাঠামোকে বিন্যস্ত করে। রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন দেশে বা একই দেশে রাজনীতিক দলসমূহের মধ্যে সাংগঠনিক কাঠামোগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। কোন দল ক্ষমতা অর্জন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই ধরনের দল তদনুসারে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলে। জনসাধারণের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও ব্যাপক জন সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে এই ধরনের দল শান্তিপূর্ণ উপায়-পদ্ধতি অবলম্বন করে। আবার এমন রাজনীতিক দলও আছে যেগুলি রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বা সশস্ত্র পদ্ধতি অবলম্বনের পক্ষপাতী। এই ধরনের দলগুলি বৈপ্লবিক বা সশস্ত্র পদ্ধতি অনুসরণের উপযোগী দলীয় সংগঠন গড়ে তোলে।

উপসংহার: অ্যালান বল রাজনীতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোর নির্ধারক হিসাবে রাজনীতিক মতাদর্শ, সরকারের সাংগঠনিক কাঠামো, আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহ, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম, রাজনীতিক সংস্কৃতি, বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান প্রভৃতি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে এই সমস্ত উপাদান পরস্পর নির্ভরশীল। তিনি বলেছেন: “All these factors, ideology, structure of government, level of socio-economic development, political culture and historical accidents’, are inter related.” এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন দলগুলির কথা বলা যায়। মার্কিন দলগুলি হল মূলত নির্বাচনী সংগঠন বা নির্বাচনী হাতিয়ার। এই দলগুলি বিকেন্দ্রীভূত। এই সমস্ত দলে রাজনীতিক মতাদর্শগত পার্থক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় না, সদস্যদের উপর দলীয় শৃঙ্খলার কোন নিগড় নেই বললেই চলে, অনেক সময় দলীয় সংগঠনের বাইরে থেকে রাষ্ট্রপতির পদের জন্য দলীয় প্রার্থী মনোনীত করা হয়। মার্কিন রাজনীতিক দলের এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের পিছনে কতকগুলি বিষয়ের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলি হল: যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতি, রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার, উদারনীতিকমতাদর্শগত ঐক্য, শিল্পায়ন, জাতিগত পার্থক্য এবং ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ। পশ্চিম ইউরোপের কমিউনিস্ট দলগুলির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ভিন্ন প্রকৃতির। এই সমস্ত দলের সদস্যদের অধিকাংশই শ্রমিক শ্রেণীর। এই সমস্ত দলে মতাদর্শগত বিশুদ্ধতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, দলের সাংগঠনিক কাঠামো হয় অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত, নেতৃত্বের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে এবং দলের সংসদীয় শাখার উপর ব্যাপক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বর্তমান থাকে। বল বলেছেন: “For explanation for some of these characteristics, one would note the predominantly parliamentary, unitary political structures of Western European States, the extension of the franchise long after the appearance of an urban working class, the political dominance of traditional conservative and liberal elites, and the success of the Bolshevik revolution in Russia and the consequent attempt to establish a Moscow dominated conformity on Western communist parties.”