দলিল সংশোধন কি? 

(What is rectification of an instrument?)

পক্ষগণের প্রকৃত অভিপ্রায় কার্যকরের উদ্দেশ্যে চুক্তিতে থাকা ভুল সংশোধনের  ক্ষেত্রে দলিল সংশোধন (rectification of instruments) একটি ন্যায়পর প্রতিকার (Equitable remedy) হিসেবে কাজ  করে থাকে যা সাধারণত লিখিত অবস্থায় দেওয়া হয়। দলিল সংশোধন সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা  ইকুইটির অন্যতম Maxim “Equity looks to the intent rather than to the form” ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। যাহোক বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ থেকে ৩৪ ধারা পর্যন্ত দলিল সংশোধন সংক্রান্ত বিধানাবলী(Provisions as to ratification of instruments) উল্লেখ করা হয়েছে।

দলিল সংশোধন নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন-১৮৭৭ এর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে প্রতারণা বা পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কোন লিখিত দলিল প্রকৃত অর্থে পক্ষগণের উদ্দেশ্য প্রকাশ করে না, সেক্ষেত্রে দলিলের যে কোন পক্ষ বা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিলটি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। সাক্ষ্য প্রমাণে আদালতের নিকট যদি সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, দলিলটি প্রণয়নের সময় প্রতারণা বা ভুল হয়েছে এবং দলিলটি কার্যকর করার জন্য পক্ষগণের প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্ণয় করা প্রয়োজন তাহলে আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary power) বলে দলিলটি সংশোধনের আদেশ দিতে পারেন। 


সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী যে কোন পক্ষের প্রার্থনায় আদালত দলিল সংশোধনের আদেশ প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ শুধুমাত্র আদালতের মাধ্যমে একটি দলিল সংশোধিত হতে পারে।

দলিল সংশোধনের শর্তাবলী(conditions rectification of instruments),

অথবা,

যখন দলিল সংশোধন কর যায়(When instrument may be rectified)


১। চুক্তি দলিলে(চুক্তিপত্র/যেকোন দলিল)পক্ষসমূহের পারস্পরিক মনোভাব লিখিতভাবে  ব্যক্ত করতে হয়। কিন্তু যখন তানা হয়ে প্রতারণা বা অন্য কোন কারণে দলিল পারস্পরিক মনোভাব ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয় তখন উভয় পক্ষই এই ধারার বিধানমতে প্রতিকার পেতে পারেন। যখন কোন পক্ষ চুক্তি দলিল সংশোধন বা রদবদল করতে চায় তখন উক্ত পক্ষকে এই ধারার বিধানমতে মামলা দায়ের করতে হবে।

২। পক্ষসমূহের পারস্পরিক ভুলের কারণে চুক্তি দলিলের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ না পেলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায়। তবে কোন লিখিত দলিল সংশোধনের জন্য যে মামলা করা হয় তাতে প্রমাণ করতে হবে যে, পূর্বে একটি চুক্তি সম্পূর্ণভাবে সম্পাদন করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে লিখিত দলিলে তা ভুলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। [এআইআর ১৯৩০ রেঙ্গুন ১২] উল্লেখ্য, পারস্পরিক ভ্রান্তির কারণে  লিখিত দলিলে কোন ভুল থাকলে তা প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য আইনের ৯২ ধারা মোতাবেক অবস্থাবিশেষ মৌখিক সাক্ষ্য গ্রহণের নজির রয়েছে।


৩। পক্ষগণের প্রকৃত ইচ্ছা বা মনোভাব দলিলে যদি ভুলভাবে লিখিত হয় তাহলে দলিল সংশোধন করা যায়।


৪। পক্ষগণের প্রতারণা বা ভুল যদি আদালত দলিল কার্যকর করার সময় নির্ণয় করতে পারেন এবং পক্ষগণের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিরূপণ করতে সক্ষম হন।


৫। কোন চুক্তিপত্রের সাথে যদি পক্ষগণের ইচ্ছা পরস্পর বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে চুক্তিপত্রটি আদালত সংশোধন করতে পারবেন।

৬। কোন দলিলে যদি পক্ষগণের সঠিক বা আসল ইচ্ছা প্রকাশ না পায়।

কারা দলিল সংশোধনের মামলা করতে পারেন

(Who can file suit for Rectification of instruments)


১। দলিলের যে কোন পক্ষ, either party, or his representative in interest

২।দলিলের যে কোন পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিগণ,

৩। দলিলের যে কোন পক্ষের উত্তরাধিকারীগণ,

৪। দলিলের যে কোন পক্ষের নিকট হতে হস্তান্তরগ্রহীতাগণ এবং

৫। দলিলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ।


মোটকথা, দলিল সংশোধনের জন্য আদালতের সামনে যদি এমন সব উপাদান যেমন– চুক্তি বা দলিলটি লিখিত ছিল(A contract or instrument in writing), জালিয়াতি বা পক্ষগুলির পারস্পরিক ভুলের(Due to fraud or mutual mistake of the parties) কারণে পক্ষগুলির আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করেনি(does not express their real intention) এবং জালিয়াতি বা পারস্পরিক ভুল আবিষ্কারের ৩ বছরের মধ্যে মামলা করা হয়েছে(Within 3 years from discovery of fraud or mutual mistake),তবে আদালত দলিল সংশোধনের নিমিত্ত তাঁর বিবেচনামূলক ক্ষমতা (discretionary power) করে সংশোধনের ব্যবস্থা করে থাকেন ৷ তবে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল প্রমাণের দায়িত্ব (Burden of proof)  সেইপক্ষের যে পক্ষ দলিল সংশোধনের প্রার্থনা করে।এই প্রমাণের ভার কঠোরভাবে অর্পিত হয়। 


দলিল সংশোধনের সীমাবদ্ধতা 

(Limitation of Rectification of Instrument)


১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায় দলিল সংশোধন সম্পর্কিত যে বিধান প্রদান করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দলিল সংশোধনের সীমাবদ্ধতাগুলো সহজেই ধরা পড়ে। দলিল সংশোধনের যে সকল সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:-


(ক) কোন এক পক্ষের মোকাদ্দমার পরিপ্রেক্ষিতে দলিল সংশোধনের আদেশ প্রদান আদালতের অবশ্যই পালনীয় কাজ নয়। দলিল সংশোধনের আদেশ প্রদান আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা(discretionary power)। 


(খ) তৃতীয় কোন পক্ষ যদি ভুল বা প্রতারণার কথা না জেনে মূল্যের বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে কোন সম্পত্তিতে কোন প্রকার স্বত্ব বা অধিকার অর্জন করে তবে দলিল সংশোধনের আর কোন উপায় থাকবে না। তবে কোন ব্যক্তি যদি প্রতারণা বা ভুলের ‘কথা জেনে বিক্রেতার স্বত্ব সম্বন্ধে কোন প্রকার অনুসন্ধান না করে নিজে লাভবান হবার ইচ্ছায় কিংবা সুযোগ গ্রহণের ইচ্ছায় যদি সম্পত্তি ক্রয় করে তবে উক্ত ব্যক্তি বিনা অবগতিতে খাঁটি ক্রেতা হতে পারবে না।


(গ) দলিল সংশোধনের অন্যতম একটি সীমাবদ্ধতা হলো যদি কোন অসংশোধিত দলিলের ভিত্তিতে কোন ডিক্রী লাভ করা হয় এবং সেই ডিক্রী যদি জারী করা হয় এবং ডিক্রী জারীর ভিত্তিতে যদি সম্পত্তি উদ্ধার করা হয় তবে আর দলিল দলিল সংশোধন করা যাবে না।


অনুলিখনের উৎস

  1. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ভাষ্য: গাজী শামছুর রহমান

  2. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন: বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া

  3. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ : জোবায়ের আহমদ (ফরিদ)

  4. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন : শ্রী দীনেশচন্দ্র দেবনাথ

  5. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ : এন এ এম জসিম উদ্দীন ও আজহারুল ইসলাম 

  6. আইনের বিশ্লেষণ- মোঃ আব্দুর রহমান হাওলাদার 

  7. ইকুইটি ও ট্রাস্ট আইন- কাম্রুন নাহার সিমা