প্রশ্নঃ ঈশ্বরের স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, ঈশ্বরের প্রকৃতি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ঈশ্বরের স্বরূপ বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা৷
ভূমিকাঃ ঈশ্বরের ধারণা উপলব্দি করার পর স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে ঈশ্বরের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। মৌলিক চিন্তাধারা ও দার্শনিক চিন্তাধারায় ঈশ্বরের স্বরূপ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। মৌলিক চিন্তাধারাকে বলা হয় ঈশ্বর এক আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত সত্তা। আর কাল্পনিক চিন্তাধারাতে ঈশ্বরের ধারাণা কতকগুলো অভিমতের ওপর নির্ভর করে । এ থেকেই আমরা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করব।
ঈশ্বরের স্বরূপ ও প্রকৃতিঃ ঈশ্বরের স্বরূপ / প্রকৃতি নিম্নরূপঃ
(১) ঈশ্বর অসীম, অনন্ত এবং স্বনির্ভরশীল সত্তাঃ ঈশ্বার সর্বদা স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে, তাই ঈশ্বর অসীম এবং অনন্ত। আর তার সৃষ্ট সকল কিছুই অসীম ও অনন্ত। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তিনি হলেন এক আত্মনির্ভরশীল পরম সত্তা। তবে ঈশ্বরের অসীমত্ব মানুষকে অন্য সৃষ্ট কিছু সসীমত্ব বা সান্তকে অস্বীকার করে না। বরং সৃষ্টজীবের সসীমত্ব স্রষ্টার অসীমদের বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। এই অনন্ত ইশ্বরকে অসীম জগতের ভেতর কেউ অতিক্রম করতে পারে না। যদি ঈশ্বর দেশ ও কালের থেকে স্বতন্ত্র হয়, তবু তিনি দেশ ও কালের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে প্রকাশ করেছেন। তাই ঈশ্বর জগতের কারণ। কিন্তু ঈশ্বরের কোনো কারণ নেই, তিনি নির্ভরশীল এক।
(২) ঈশ্বরই পরম সত্তার পরিচায়কঃ ইশ্বরই হলো একক পরম সত্তা। কেননা, ঈশ্বরের ধারণা উপলব্ধি করতে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য নেয়া লাগে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অন্য কোনো সত্তার ওপর নির্ভরশীল নয়। ঈশ্বর ও জীব আত্মার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সকল বস্তু ও জীব আত্মা ঈশ্বরের মধ্যেই বিদ্যমান। ঈশ্বরের বাইরে নয়। সকল শর্ত, সম্বন্ধ ঈশ্বর ধারণ করেন। কিন্তু ঈশ্বর কোনো শর্তের মুখাপেক্ষী নয়। তাই ঈশ্বর এক পরম ঐক্যের নাম, যা সকল সুষম সমন্বয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
(৩) ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা ও পরম প্রজ্ঞাময়ঃ যেহেতু ঈশ্বর অসীম, প্রবাহ এই বিশ্ব জগত সসীম। তাই ঈশ্বর কর্তৃক এ বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে আর ঈশ্বর তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। জগত ও ঈশ্বরের মধ্যে এক গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই জগত ছাড়া ঈশ্বর শূন্যগর্ভ, স্রেফ সম্ভাবনামাত্র। আবার ঈশ্বর দ্বারা জগত অপূর্ণ থেকে যায়। জগতের মধ্যকার শৃঙ্খলা, সমস্যা ঐক্য পরমসত্তা ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ করে। তার সৃষ্টি ও নিয়মানুবর্তিতা তাকে পরম প্রজ্ঞাময় ও ধীশক্তির অধিকারী বলে মনে করে।
(৪) ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞঃ ঈশ্বর অবশ্যই সর্বশক্তিমান, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তিনি সম্ভব ও অসম্ভব বা ন্যায়সঙ্গতসহ সকল কাজই ঘটিয়ে থাকেন। তবে এটা সত্য, ঈশ্বর সব কিছু করতে পারেন, কিন্তু তিনি নিজের স্বরূপের সাথে মিল রেখে প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু করেন না। তিনি তার নিজস্ব প্রকৃতি অনুসরণ করে চলেন যা সর্ববিরোধিতামুক্ত। ঈশ্বরের আরেক বা প্রকৃতি, তিনি সর্বত্র বিরাজ করেন। কেননা, ঈশ্বর যদি সর্বত্র বিরাজমান না থাকে, তাহলে ঈশ্বরবহির্ভূত সত্তা ঈশ্বরকে সীমিত করে। তা ছাড়া ঈশ্বর সর্ববিষয়ে অধিগত। জগতের ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কোনো কিছুই তার অজানা নয়। তিনি ভবিষ্যৎ জানেন কিন্তু অতীত থেকে নয়। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একটা অনন্ত বর্তমানরূপে প্রত্যক্ষ করে। ঈশ্বর মানুষের কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। আল্লাহ তার সিদ্ধান্তের ওপর কাজ করার শক্তি দেন। সে ভালো কাজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে আবার খারাপ কাজের সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষ পুরোপুরি স্বাধীন। আল্লাহ কারো ইচ্ছাশক্তির ওপর হস্তক্ষেপ করেন না। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা না থাকলে ভালোমন্দ কাজের জন্য তাকে নৈতিকভাবে দায়ী করা যেত না। আর ঈশ্বরের কাছে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। তিনি সবকিছু বর্তমানরূপে প্রত্যক্ষণ করেন। তিনি সদা সর্বদা-সর্বত্র বিরাজমান। তিনি আগে-পরের সবকিছু জানেন।
(৫) ঈশ্বরই একমাত্র পরম প্রজ্ঞাবানঃ ঈশ্বরই জগতের একমাত্র স্রষ্টা। তিনি এখানে তার স্বর্গীয় প্রজ্ঞার প্রকাশ করেছেন। তিনি শুধু পৃথিবী সৃষ্টিই করেননি একে অনবরত পরিচালনা করছেন সুশৃঙ্খলভাবে। বিশ্বজগতের অন্তর্ভুক্ত উপাদানসমূহ নিয়মিত শৃঙ্খলায় আবদ্ধ, যা তার পরম প্রজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ। ঈশ্বরই এই জগতের মূল সত্তা বা আদি কারণ। তাছাড়া ঈশ্বর এ বিশ্বজগতের অন্তবর্তী সত্তা। তিনি বিশ্বজগতের আদি থেকে পরিণতি উপাদান। তাই ঈশ্বর ও জগত আলাদা করা যায় না। এরা পরস্পর নির্ভরশীল।
(৬) ঈশ্বর পরমাত্মাঃ ঈশ্বর অসীম, তার সৃষ্ট সবকিছুই অসীম। ঈশ্বরের অসীমত্ব তার সৃষ্ট অসীমের মধ্য দিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছেন। ঈশ্বর আধ্যাত্মিক সত্তা। তার চেতানার বস্তু হিসাবে এ জগত সৃষ্টি হয়েছে। অসীম সত্তা তার অপূর্ণতার সামাপ্তি ঘটাতে অসীম সত্তার দিকে ধাবিত হয়। ঈশ্বর যেহেতু এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা, তাই এই বিশ্বজগতে তার চেতনা বিস্তৃত রয়েছে। এ চেতনার পূর্ণ পরিতৃপ্তি ও আত্মোপলব্ধি সামাজিক, নৈতিক, মানবতার ইতিহাস প্রভৃতি অভিব্যক্তির মাধ্যমে করে থাকেন। এই পরমাত্তার মাধ্যমেই জগতে নেমে আসে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তি।
(৭) ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তাঃ সকল অপূর্ণতার মাঝে একমাত্র ঈশ্বরই পূর্ণ-সত্তা। তিনি চাহিদা, অভাব, অনুভূতির ঊর্ধ্বে। তবে তার প্রকাশ অপূর্ণতার মাধ্যমে ঘটেছে। অপূর্ণতার দোষে ঈশ্বরকে দুষ্ট করা যায় না। কেননা, ঈশ্বর পূর্ণতার অধিকারী একই চলমান কিছু অপূর্ণ হয়ে তার অধিকারে বিদ্যমান রয়েছে। জগতের স্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বর অপরিনামী অর্থাৎ ঈশ্বর আত্মসংগতিপূর্ণ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এটা না হলে এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি ও বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ত।
(৮) ঈশ্বর নৈতিকতার জনকঃ নৈতিকতার দিক থেকে ঈশ্বর এমন একটি সত্তা, যা পরিপূর্ণ এবং পূত-পবিত্র। তিনি সকল পাপ-পুণ্যের একমাত্র বিচারক। তিনি তার সৃষ্ট-জীবের প্রতি কখনোই অবিচার করেননি। তিনি পরম দয়াময় ও ন্যায়বিচারক। তিনি পাপের জন্য শাস্তি ও পুণ্যের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। তার বিচারের ভয়ে জীব জগতে ও বিশ্বভূমিতে সৃষ্টিতে শৃঙ্খল, নৈতিক ও সামাজিক বন্ধন ও নীতি দেখা যায়।
(৯) ঈশ্বর সকল আদর্শের প্রেরণাঃ সৃষ্টির আদিতে মানুষের মাঝে ঈশ্বর সম্পর্কে ব্যাপক ভ্রান্ত ধারণা ছিল। মানুষেরা ঈশ্বর সম্পর্কে জানত যে তিনি সর্বজান্তা, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশক্তিমান। এই সব বৈশিষ্ট্যে রূপ তাদের কাছে ছিল ব্যাপক ও ভয়াবহ। কিন্তু পরবর্তীতে ভাববাদী দর্শনের মাধ্যমে জানা যায়। ঈশ্বর শুধু সর্বশক্তিমানই নয়, তিনি আদর্শেরও মূর্ত প্রতীক ও জনক। তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন না। তিনি ন্যায়ের বিপরীত বা অসংগত কিছুই করেন না। তাই ঈশ্বর সত্য, শিব ও সুন্দরের প্রতীক। এ কারণে তিনি সকল জাগতিক মূল্যের আদর্শস্বরূপ।
(১০) ঈশ্বর কল্যাণকামী ও দয়াময়ঃ তত্ত্বের দিক থেকে ঈশ্বরের প্রকৃতি বিবেচনা করতে হলে তার অন্তর্ভুক্ত গুণগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। ধর্মের দিক থেকে বিচার করে কতকগুলো মানবিক গুণ ঈশ্বরের ওপর প্রয়োগ করা হয়। যেমন ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ ও কল্যাণময়। প্রেমময় ও দয়াময়। অন্ধ-বিশ্বাসের দরুন ভক্তের ধারণা ঈশ্বর একটা পুরুষ; তবে সাধারণ নয়, তিনি পুরুষোত্তম। তিনি ভক্তের ডাকে সারা দেন এবং তার মনোবাসনা পূর্ণ করেন। তিনি আত্মচেতনা, ইচ্ছা, অনুরাগ সমন্বিত এক মহাপুরুষ।
কিন্তু যিনি পুরুষ, তিনি আত্মসচেতন। ঈশ্বর যদি পুরুষ হন, তাহলে অন্য আরেকটা ভিন্ন সত্তাকে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়, যার জন্য তিনি আত্মসচেতন হতে পারেন। কিন্তু দার্শনিক মতে, ঈশ্বর যেহেতু অসীম ও সর্বনিরপেক্ষ, তাই তাকে পুরুষ বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ তাদের মতে, ঈশ্বরের পুরুষত্ব তার অসীমত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পায়। কারণ পরম সত্তা যদি পুরুষ হয়, তাহলে তার পরে মূর্ত ও আত্মসচেতন শক্তি হওয়া কীভাবে সম্ভব। ঈশ্বরে এ মতবাদের অর্থাৎ ঈশ্বর পুরুষ বলে মত দিয়েছেন বলফোর এবং এ মতে, বিরোধিতা করেছেন স্পিনোজা কারণ স্পিনোজার মতে, ঈশ্বর পুরুষ নয়, ঈশ্বর এক পরম দ্রব্য। কেননা, তিনি এক অমৃত সত্তা, যার এমন কোনো উপাদান নেই। ‘যে সম্পর্কে তিনি সচেতন হতে পারেন।
আবার হেগেল দেখালেন যে ঈশ্বর সর্বনিরপেক্ষ। তার মতে, ঈশ্বর হলেন এক আত্মসচেতন সর্বনিরপেক্ষ ঐচ্ছিক সত্তা, যিনি তার আত্মপ্রকাশের এবং আত্মপূর্ণতার বিভিন্ন স্তরে বহু উপাদানেকে বিকশিত করেন। তাই ঈশ্বরবহির্ভূত কোনো কিছুর দ্বারা সীমিত নয়। তিনি পরম কল্যাণময় ও ন্যায়বিচারক।
উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার প্ররিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত যেসব ধারণা, তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে একেশ্বরবাদে যারা বিশ্বাসী, তাদের ধারণাটা তুলনামূলক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ঈশ্বর সম্পর্কে যত ধারণা বা তত্ত্বই থাক না কেন, ঈশ্বর যে এক, তা সকল মানুষ ও মতবাদ যুক্তি দিয়ে প্রমাণযোগ্য বলে মনে করে। এর কারণ পৃথিবীতে আমরা প্রকৃতির রাজ্যে যে বর্ণানীত নিখুঁত শৃঙ্খলা দেখতে পারছি- তা একের অধিক ঈশ্বর থাকলে সম্ভব হতো না। তাই মানুষ এক ঈশ্বরের প্রার্থনা করে। তার প্রতি বিশ্বাস আনে এবং এ পথেই আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করে। তাই মানবজীবনে ঈশ্বরের ধারণার গুরুত্ব অপরিসীম।
Leave a comment