প্রশ্নঃ দর্শনের সাথে সহজ বুদ্ধির সম্পর্ক তুলে ধর।

অথবা, দর্শনের সাথে সহজ বুদ্ধির সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, দর্শনের সাথে লৌকিক জ্ঞানের সম্পর্ক আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ একজন চিন্তাশীল মানুষের জন্য এই জগৎ বিচিত্র রহস্যের হাতছানি। জগতের যাবতীয় বস্তুনিচয়ের জন্ম-মৃত্যু-উৎপত্তি-বিলয় ও বিকাশের প্রক্রিয়া তাকে মুগ্ধ করে। এসবের একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা সে দাঁড় করাতে চায় নিজস্ব চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে। এই মানবিক প্রচেষ্টার নামই দর্শন। তাই বিস্ময়বােধ ও কৌতূহলের তাগিদেই মানুষ অবলীলাক্রমে চালিত হয়। অজানাকে জানার, জগত সংসার ও মানবজীবনের বিবিধ রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে কৌতূহলি মানুষ তার শতসীমার দূতকে উপেক্ষা করে ব্রতী হয় জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের দুঃসাধ্য কাজে।

দর্শনের সাথে সহজ বুদ্ধির সম্পর্কঃ নিম্নে দর্শনের সাথে সহজ বুদ্ধির সম্পর্কগুলাে তুলে ধরা হলাে-

দর্শনের স্বরূপঃ জগৎ ভাবনা ও জীবনের অর্থানুসন্ধান কেবল মুষ্টিমের পণ্ডিত, গবেষক বা ভাবুক দার্শনিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, মানুষ মাত্রই এ নিয়ে অল্প-বিস্তর কৌতূহলবােধ করে। জীবনের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও পরিণতি নিয়ে সবাই কম-বেশি ভাবে। তবে দার্শনিক ও সাধারণ মধ্যে পার্থক্য শুধু এখানে যে, কোনাে প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধানে দার্শনিকরা যে সুশৃঙ্খল-প্রণালিবদ্ধ পথ অনুসরণ করেন, যুক্তি বিচারের মাধ্যমে উত্থাপিত প্রশ্নের সদুত্তর আবিষ্কারে তারা যেভাবে ব্রতী হন, সাধারণ মানুষ তেমনটি করে না। দার্শনিকের প্রধান অবলম্বন যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণ, পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল সরল বিশ্বাস, গতানুগতিক সংস্কার, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় আচার-অনুশাসন।

লৌকিক জ্ঞানের স্বরূপঃ সাধারণত কাণ্ডজ্ঞান বলতে বােঝায় মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তির প্রখরতা বা সহজাত মেধাশক্তিকে। সাধারণ জ্ঞানকে বলা হয় কাণ্ডজ্ঞান। এ অর্থে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হয়েও একজন প্রবল সাধারণ, জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন, আবার আমরা এমনও অনেক ধারণা পােষণ করে থাকি। তা ছাড়া অনেক বিশ্বাসও লালন করে থাকি যেগুলাের ভিত্তি ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তােলা হয় না। এগুলােকে আমরা গ্রহণ করি সরল বিশ্বাসে এবং মেনে নেই নির্বিবাদে। এভাবে একটি জনগােষ্ঠীর যেসব ধারণা ও বিশ্বাস বিনা বিচারে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়ে থাকে সেগুলাের সমষ্টিকে বলা হয় সাধারণ জ্ঞান বা কাণ্ডজ্ঞান। জে. হসপার্স তার An Introduction to philosophical Analysis গ্রন্থে বলেন, ‘লৌকিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যৌক্তিক কিছু পাই না, সবই হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতাে।’

(১) ব্যাপকতার ক্ষেত্রেঃ দর্শনের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। জ্ঞানের এমন কোনাে শাখা নেই যা দর্শনের আলােচনার আওতাভুক্ত নয়। লৌকিক জ্ঞান ও জাগতিক বিষয়গুলােকে নিয়ে দর্শন সার্বিকভাবে কাজ করে। কাজেই পরিধিগত দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য হয়েছে।

(২) বিষয়বস্তুগত দিকঃ বিষয়বস্তুগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় দর্শন ও লৌকিক জ্ঞান উভয়ই জীবন ও জগতের রহস্য উদ্ঘাটন করে চরম সত্যকে আবিষ্কার করতে চায়।

(৩) উদ্দেশ্যগত দিকঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞান উভয়েরই উদ্দেশ্য হলাে জীবন ও জগতের রহস্য উদ্ঘাটন করা।

(৪) চিন্তাগত দিকঃ দর্শন হলাে বিস্তার নীতিমান সংক্রান্ত বিজ্ঞান। চিন্তার নীতিমালা অনুসরণের মধ্যে দিয়েই দর্শন সত্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে। আবার লৌকিক জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিচিন্তার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কাজেই চিন্তাগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

(৫) মানবতা রক্ষা সংক্রান্ত কাজঃ দার্শনিক চিন্তাধারার লক্ষ্য হলাে মানবকল্যাণ। দর্শন যুক্তিভিত্তিক উপায়ে মানব কল্যাণে নিয়ােজিত। দর্শনও লৌকিক জ্ঞানের দ্বারা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে থাকে।

(৬) সংশয় প্রশ্নেঃ দর্শনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে যেমন সংশয় কাজ করে, তেমনি লৌকিক জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রেও সংশয়ের প্রভাব দেখা যায়।

দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের মধ্যে বৈসাদৃশ্যঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের স্বরূপ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আলােচনা করলে উভয়ের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে সেগুলাে তুলে ধরা হলাে-

(১) উপায়গতঃ দর্শন যুক্তির মাধ্যমে আলােচ্য বিষয়ের সমাধান করার চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে, লৌকিক জ্ঞান লৌকিক উপায়ে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।

(২) কাজের ক্ষেত্রঃ দর্শন জীবন ও জগৎ বিষয়ক মৌলিক প্রশ্নাবলির যৌক্তিক অনুসন্ধানে নিয়ােজিত। পক্ষান্তরে, লৌকিক জ্ঞান কোনাে যুক্তি বা বিচার-বিশ্লেষণের ধার ধারে না।

(৩) সম্পর্কগত বিষয়ঃ দর্শন সবকিছুকে সামগ্রিক বিবেচনা করে। মানব অভিজ্ঞতার কোনাে দিকই দর্শনের আলােচনা থেকে বাদ যায় না। অন্যদিকে লৌকিক জ্ঞান মানব জীবনের সাময়িক রাস্তার সাথে সম্পর্কিত।

(৪) অন্ধকার ও কুসংস্কারঃ দর্শনে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কোনাে স্থান নেই। অপরদিকে লৌকিক জ্ঞান কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মুক্ত নয়।

(৫) পদ্ধতিগত দিকঃ দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রবৃত্তিভিত্তিক। পক্ষান্তরে, লৌকিক জ্ঞান সামঞ্জস্যহীন ও অসংলগ্ন।

(৬) জ্ঞানের দিক থেকে মূল্যায়নঃ দার্শনিক জ্ঞান বৈজ্ঞানিক ও প্রকৃত জ্ঞান। পক্ষান্তরে, অনেক দার্শনিক। লৌকিক জ্ঞানকে অবৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলে অভিহিত করেন।

(৭) উদারগত দিকঃ বিচার-বিশ্লেষণ থেকে উদ্ভূত বলে দার্শনিক জ্ঞান উদার প্রকৃতির, অপরপক্ষে লৌকিক জ্ঞান উদার নয়।

(৮) মনকে সন্তুষ্ট করাঃ সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শ নিয়ে আলােচনা করে বলে দর্শন মানব মনকে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত করতে পারে। অন্যদিকে, লৌকিক জ্ঞান যুক্তিনির্ভর মনকে তৃপ্ত করতে পারে না।

(৯) জ্ঞানের ক্ষেত্রে মূল্যায়নঃ দর্শনের জ্ঞান চূড়ান্ত জ্ঞান। অন্যদিকে, লৌকিক জ্ঞানকে জ্ঞানের প্রাথমিক পর্ব বলে অভিহিত করা হয়।

(১০) সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রঃ দার্শনিক সত্য সর্বজনীন। অন্যদিকে, লৌকিক জ্ঞানের সত্য ব্যক্তিগত।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ দর্শন ও লৌকিক জ্ঞানের মধ্যে বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও এরা পরস্পর নির্ভরশীল। কেননা সহজ বুদ্ধি ও লৌকিক জ্ঞানের অসামস্যতা ও অনিশ্চয়তা থেকে দর্শনের উদ্ভব। এদিক থেকে বলা যায় যে, সহজ বুদ্ধি বা লৌকিক জ্ঞান থেকে দর্শনের যাত্রা শুরু হয়। সহজ বুদ্ধি বা লৌকিক জ্ঞানকে প্রাথমিক জ্ঞান ও দার্শনিক সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান বলা যায়। সুতরাং বলা যায়, লৌকিক জ্ঞান দার্শনিক জ্ঞানের সূচনা করে। আর এভাবেই লৌকিক জ্ঞান ও দর্শন পরস্পরের সাথে ওতপ্রােতভাবে নির্ভরশীল।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সাধারণ জ্ঞান হলাে অস্পষ্ট এবং অগােছালাে। কিন্তু বিজ্ঞান সেই জ্ঞানকেই করে স্পষ্ট এবং সংবদ্ধ। এদিক থেকে বিজ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের পরবর্তী উচ্চতর পর্যায়। বিজ্ঞান মাত্রই প্রকৃতির একটি বিশেষ বিভাগের সুশৃঙ্খল জ্ঞান। জগৎ ও জীবনের সর্বাত্মক ও সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান পাওয়া যায় কেবল দর্শনে। সুতরাং বুঝা যায়, দর্শনই হচ্ছে সব মৌলিক সমস্যা সমাধানের প্রধান নিদের্শক। এককথায় জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে দার্শনিক জ্ঞানই আমাদেরকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু তাই বলে লৌকিক জ্ঞানকে অস্বীকার করা যায় না।