প্রশ্নঃ দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক আলােচনা কর।

অথবা, দর্শনের সাথে ধর্ম কীভাবে সম্পর্কযুক্ত?

ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সবাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা।

দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্কঃ দর্শনের সাথে ধর্মের সম্পর্ক আলােচনা করতে হলে দর্শন ও ধর্মের স্বরূপ, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য এবং পরস্পরের মধ্যে নির্ভরশীলতা প্রভৃতি উল্লেখ করা প্রয়ােজন। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

দর্শনের স্বরূপঃ আক্ষরিক অর্থে দর্শন হচ্ছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা সত্যের অনুসন্ধান। দর্শন যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে পরম সত্তা, জগৎ-জীবনের সাথে জড়িত সমস্যাবলির সূক্ষ্ম এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দান করে। দর্শন জীবন ও জগতের মূল্য অবধারণ করে।

ধর্মের স্বরূপঃ বিশ্বাসই ধর্মের মূলভিত্তি। ধর্ম হলাে এমন এক অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস, যে শক্তি বিশ্বের সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে রয়েছে একজন সৃষ্টিকর্তা। যিনি বিশ্বের সব কিছুরই মালিক। মানুষ তার সান্নিধ্য লাভের আশায় তার কাছে ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা অর্পণ ও নিজেকে সমর্পণ করে থাকে। জাকসের মতে, ‘অতি উৎকৃষ্টের প্রতি অনমনীয়ভাবে আনুগত্য প্রকাশই হচ্ছে ধর্মের জীবনীশক্তি।

দর্শন ও ধর্মের মধ্যে সাদৃশ্যঃ দর্শন ও ধর্ম উভয়েরই উদ্দেশ্য এ বিশ্বজগতের রহস্য উদঘাটন, বিশ্ব পরিকল্পনায় মানুষের স্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ণয়ের ব্যাখ্যা। উভয়ই সার্বিক নীতি সম্পর্কে আলােচনা করে। স্রষ্টা, সৃষ্টি, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় দর্শন নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচনা করে। সুতরাং ধর্ম ও দর্শন পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত।

দর্শন ও ধর্মের মধ্যে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যঃ দর্শন ও ধর্মের মধ্যে উৎপত্তি ও বস্তুগত দিক থেকে যদিও কতগুলাে সাদৃশ্য রয়েছে, তথাপি এদের মধ্যে কতগুলাে বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্যও রয়েছে। নিচে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আলােচনা করা হলাে-

(১) ধর্ম ও দর্শনের লক্ষ্য ভিন্ন দর্শনের লক্ষ্য সত্য, আর ধর্মের লক্ষ্য কল্যাণ। নিছক পরম সত্তার বিশ্বাসের আলােকে কল্যাণ লাভই ধর্মের উদ্দেশ্য।

(২) দর্শনে আচার-অনুষ্ঠান নেই, দর্শন জ্ঞানচর্চা। পক্ষান্তরে, ধর্মে আচার-অনুষ্ঠান আছে, ধর্ম জীবনচর্চা।

(৩) দর্শনের সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান হচ্ছে সুস্পষ্ট, সুসংহত এবং যুক্তিপূর্ণ। পক্ষান্তরে ধর্মের সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ।

(৪) দর্শনের কাজ হলাে প্রধানত বুদ্ধিভিত্তিক বা বিচারভিত্তিক। পক্ষান্তরে ধর্মের কাজ হলাে বিশ্বাসভিত্তিক বা ব্যবহারিক।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বিষয়বস্তুগতভাবে আমরা দেখেছি যে দর্শন ও ধর্ম উভয়ই জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটন করে চরম সত্যকে আবিষ্কার করতে চায়। দর্শন যদি নিরপেক্ষ হয় এবং ধর্ম যদি অন্ধ গোড়ামির প্রভাবমুক্ত থাকে তাহলে উভয়ে জগতের রহস্যকে সুষ্ঠুভাবে উন্মােচন করতে পারে। পাশ্চাত্যের মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ তাই ধর্ম ও দর্শনকে এক ও অভিন্ন মনে করেন। সুতরাং দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক খুবই নিবিড়।