অথবা, দর্শনের প্রধান কাজগুলাের বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা। দৈনন্দিন জীবনে দেখা বলতে আমরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণকে বুঝি। কিন্তু এখানে দেখা মানে চাক্ষুষ দেখা নয়। দর্শন হচ্ছে জীব ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি।
দর্শনের সংজ্ঞাঃ দর্শনের সংজ্ঞা চট করে দেয়া সম্ভব নয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। এসব সংজ্ঞা পর্যালােচনা করলে যে সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দার্শনিকই জগৎ জীবনের ব্যাখ্যা, জগতের সংগে জীবনের সম্পর্ক, স্রষ্টার সংগে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্বারােপ করেছেন।
দর্শনের প্রধান কাজঃ দর্শনের সংজ্ঞা আলােচনা করতে যেয়ে একটি বিষয় সম্পর্কে আলােচনার অবকাশ থেকে যায় এবং সেটা হলাে দর্শনের কাজ কী। দর্শনের আলােচনার পরিপূর্ণতার জন্য আমাদের দর্শনের কাজ সম্পর্কে জানতে হবে। দর্শনের কাজ মূলত তিন প্রকারের। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে।
(১) গঠনমূলক কাজঃ অনেকে মনে করেন, দর্শনের কাজ শুধু সমালােচনা করা, কিন্তু একথা একেবারেই সত্য নয়। দর্শনের গঠনমূলক দিক বিদ্যমান। বিজ্ঞান প্রকৃতির এক একটা দিক নিয়ে আলােচনা করে এবং এই আলােচনার মাধ্যমে কতগুলি সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করে। প্রতিটি বিজ্ঞান প্রকৃতিকে খন্ড খন্ডভাবে বা আংশিকভাবে তুলে ধরে বা উপস্থাপন করে। সার্বিকভাবে তুলে ধরে না। কিন্তু দর্শন প্রকৃতির খণ্ড খণ্ড রূপ তুলে না ধরে। খণ্ড খণ্ড রূপকে সমন্বয় করে একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরে। আর দর্শন শুধু দৃশ্যমান জগৎ নয়, অতীন্দ্রিয় জগৎ নিয়েও আলােচনা করে। দর্শন জীবনের পরম আদর্শ যেমন—সুখ, ভালাে, মন্দ, সত্য, কল্যাণ, সুন্দর প্রভৃতির যৌক্তিকতা আছে কি-না তা বিশ্লেষণ করে। কাজেই দর্শনে গঠনমূলক কাজ বিদ্যমান। দর্শন শুধু মৌলিক প্রশ্নের অনুধ্যানমূলক এবং বিচারমূলক আলোচনা করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং এসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের একটা সামাজিক বা সংগঠনমূলক ধারণা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। তাই দর্শনের কাজের তৃতীয় ও প্রধান ধাপ সংগঠনমূলক। দর্শনের ভাণ্ডার হলাে জ্ঞানের একটা পূর্ণভাণ্ডার। বস্তুর বাহ্যরূপ ও অন্তরসত্তারস্বরূপ, সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শের স্বরূপ, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের স্বরূপ ইত্যাদি সম্পর্কে আলােচনা করে এ বিশ্বের এক মূল উপাদানের সন্ধান আবিষ্কার করাই হচ্ছে আবহমানকাল থেকে দর্শনের কাজ।
(২) অনুধ্যানমূলক কাজঃ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব হিসেবে মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। বিশাল, বিচিত্র, রহস্যময় জগতের দিকে তাকালে মানুষের মন বিস্ময়ে ভরে ওঠে। তার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে, এ জগতের মালিক কে? কে এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রক কে? বহির্জগৎ কি প্রকৃত জগৎ। অতীন্দ্রিয় কোনাে জগৎ আছে কি-না? থাকলে তার স্বরূপ কী? মানুষের সাথে জগতের কী সম্পর্ক? জীবনের স্বরূপ কী? জীবন পরম আদর্শ কী? মরণ কী? মৃত্যুর পর কি কোনাে জগৎ আছে? আত্মা কেমন? আত্মা আছে কি-না? জীব জড় কী? এদের সম্পর্ক কি? আত্মার অমরত্ব বলতে কী বােঝায়? দেহ ও প্রাণের কী সম্পর্ক? মন না দেহের প্রাধান্য বেশি? এসব প্রশ্ন আমাদের মনে সহজতরভাবে এসে যায়। আর এ প্রশ্নগুলাের উত্তর খুঁজতে গেলে মানুষকে ভাবতে হয়, চট করেই এর উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না। আর ভাবতে গিয়েই মানুষ চিন্তাশীল হয়। এসব প্রশ্নের বুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যা দেবার যে প্রচেষ্টা এটাই দর্শনের আসল বিষয়। এ অনুধ্যানের মাধ্যমে দর্শন আজকে বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কাজেই দর্শনের কাজ হলাে অনুধ্যানমূলক।
(৩) সমালােচনামূলক কাজঃ আমরা একটা কথা সবাই জানি, সেটা হলাে “নানা মুনির নানা মত”। একথাটি, দর্শনের ক্ষেত্রে পুরােপুরি সত্য। দর্শনের এই নানা মতই দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে। এই নানা মতই সমালােচনা। আমরা দেখি। জীবনের মৌলিক প্রশ্ন সম্পর্কে অনেক সময় লৌকিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু এ লৌকিক ব্যাখ্যা মানুষের মনকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। তাই কোনাে ব্যাখ্যার মধ্যে মানুষ যখন প্রশ্ন তােলে তখনই সমালােচনার সৃষ্টি হয়। দর্শনের কাজ নির্বিচারবাদী নয়; বিচারমূলক। দর্শন কোনাে কিছু বিনা বিচারে গ্রহণ করে না। বিচার গ্রহণ করে যেটা নির্ভুল প্রমাণিত হয় সেটাকেই দর্শন গ্রহণ করে। দর্শন বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলােকেও বিনা বিচারে গ্রহণ করে না। বিজ্ঞানের এমন অনেক বিষয় আছে যেমন-এটম বােমা। এটা মানব জাতির জন্য আশীর্বাদ বা অভিশাপ তা দর্শন সমালােচনার মাধ্যমে বের করে। এটম বােমার যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে এর সম্পর্কে মতামত দিয়ে থাকে। কাজেই দর্শনের একটা বিরাট কাজ হলাে সমালােচনামূলক।
পরিশেষঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, দর্শনের কাজ মানুষের কাছে সত্যকে পৌঁছে দেয়া। দর্শন মানুষকে সত্যের সামগ্রিক রূপ জানতে সাহায্য করে। অনুধ্যান, সমালােচনা ও গঠন এই তিনটির মাধ্যমে দর্শন তার অগ্রযাত্রাকে আরাে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দর্শন চিন্তা করে, সমালােচনা করে এবং এ দুটোর সমন্বয় করে কীভাবে মানবকল্যাণ করা যায় সেটাও দর্শন আলােচনা করে। কাজেই দর্শন একটা সার্বিক বিষয়।
Leave a comment